জালালুদ্দিন শেখের নৌকা ও একটি গ্রীষ্মকাল
গরম পড়তে না পড়তেই বেহুলার জল যে গরম হচ্ছে বেশ বুঝতে পারে জালাল। আস্তে আস্তে জল কমবে, স্রোতহীন হবে, কচুরিপানায় ভরে যাবে নদীর পেট। শুধু এই রসিকপুর ঘাটের সামনেটুকুই টলটল করবে জল। এটুকুই জালালের নৌকার রাজপথ। জালালুদ্দিন শেখ রসিকপুর ঘাটের মাঝি। বিডিও অফিস থেকে ডাক নিয়ে ফি বছর পারাপার করায় মানুষ, গরু, সাইকেল-বাইক। ওর বাবাও তাই করত। বাঁশে লগি ডুবিয়ে জালাল চাপ দেয় বেহুলার পেটে আর ওর নৌকা রসিকপুর থেকে এগিয়ে যেতে থাকে ওপারের নন্দগ্রামের দিকে। জালালের ছোটোবেলায় এমন অবস্থা ছিল না বেহুলার। তখন ওর বাপের সঙ্গে বৈঠা বাইতে পারত। এখন শুধু বৃষ্টি হলেই জল বাড়ে। পাড়ে পৌঁছে নৌকা খুঁটির সঙ্গে বাঁধে জালাল। নৌকার মাথা থেকে সরু তক্তা পেতে দেয়। সেই তক্তার উপর দিয়ে নামার সময় যাত্রী ওঁর হাতে গুঁজে দেয় কয়েন। জালাল যত্ন করে লুঙ্গির কোঁচড়ে রাখে। যাত্রী, সাইকেল, মোটর সাইকেল এমনকি গরু-ছাগলেরও আলাদা আলাদা ভাড়া।
বেহুলাই রসিকপুরকে কেটে আলাদা করে বয়ে গেছে পূর্বদিকে। একদিকে রয়ে গেছে নন্দগ্রাম ও তার সকল সুযোগ-সুবিধা। অন্যদিকে হাজার-বারোশো বাসিন্দা নিয়ে রসিকপুরের নেই রাজ্যের জগত। একেবারেই কিছু নেই বলা যায় না। রসিকপুরে বিদ্যুৎ এসেছে, টিউবকল বসেছে, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র আছে, প্রাইমারি স্কুল আছে। কিন্তু হাইস্কুল যেতে গেলে বা অসুস্থ হলেই হাসপাতাল— ওপাড়ের নন্দগ্রামে। পঞ্চায়েত অফিস থেকে বাজার সবই নন্দগ্রামে। আর এই দুই জগতের মাঝে বেঁচে আছে জালালুদ্দিন শেখ ও তাঁর নৌকা। বেহুলার উপর দিয়ে একটা ব্রিজ আছে বটে তবে তা পাঁচ কিলোমিটার দূরে আনন্দনগরে। খুব প্রয়োজন না পড়লে এদিকের লোক অতদূরে যায় না। রসিকপুর ঘাটে একটা ব্রিজের দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু দাবি বাস্তবায়নের যে উদ্যোগ প্রয়োজন তা কিছুতেই দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। ভোট এসেছে, ভোট গেছে। সরকার, পঞ্চায়েত, সদস্য বদলেছে তবু ব্রিজের দাবির কিছুই হয়নি।
জালালুদ্দিন নদীর পাড়েই থাকে। গোয়ালে দুটো গরু আছে। জালালের বউ সেই গরুর দুধ গ্রামে বেচে। সারা পৃথিবীর সমস্যা নিয়ে ওঁর নিজের কোনো মাথাব্যথা নেই, নিজের সমস্যা নিয়েও যে আছে— বোঝা যায় না। হয়তো এই সমস্যা নিয়ে বাঁচতে বাঁচতেই সমস্যাতেই নিজেকে মানিয়ে ফেলেছে ও। জালাল নৌকা বাওয়ার অবসরে নদীতে ঘুনি পাতে, মাছ ধরে। এটুকুই যা ওঁর সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য। পারাপার করাতে করাতে জালাল মাঝির সঙ্গে গ্রামের সকলেরই সখ্যতা। লোকে পুজোর বাজার করে নৌকাতে উঠে যেমন জালালের সঙ্গে গল্প জোড়ে, তেমনিই রসিকপুরে মেয়ে দেখতে আসা পাত্রপক্ষকে রাস্তা বাতলে দেয় জালালই। বলা যায়, গ্রামের সকলের হাঁড়ির খবর জালালের কাছে। এত কিছু জানা সত্ত্বেও জালাল কোনোকিছু নিয়ে ভাবে না। ভাবতে গেলেই ওঁর মাথায় কেমন তালগোল বেঁধে যায়। এই গ্রীষ্মকালে গ্রামের আলোচনাটা একমুখী। জালালের নৌকায় পার হতে হতে সে আলোচনা জমাট বাঁধে, কুয়াশা হয়। এতদিনের দাবির স্বপক্ষে এককাট্টা হচ্ছে রসিকপুর। ব্রিজ হলে জালালের কতটা সুবিধা বা অসুবিধা হবে জালাল কখনো ভাবেইনি। কিন্তু এ গরমে জালাল ভাবল, মানে ভাবানো হল।
এবার গরম পড়তে না পড়তেই বেহুলার জল গরম হচ্ছে। গরম হয়েছে গ্রামের আবহাওয়াও। সামনেই নির্বাচন। শাসক-বিরোধী দু’ পক্ষেরই প্রচার তুঙ্গে। কিন্তু রসিকপুরের একদল লোক দল বেঁধেছে— ব্রিজ নাই তো ভোট নাই। দলটা জমাট বাঁধছে আর বড়ো হচ্ছে। রসিকপুরের এই দল একদিন ডেপুটেশন দিল সেতুর দাবিতে বিডিও-র কাছে। সবাই নদী পার হল জালালের নৌকাতেই। গ্রামের মানুষ বুঝেছে নির্বাচনের মধুতেই আকর্ষণ করতে হবে রাজনৈতিক দল থেকে প্রশাসনকে। তাই ভোটকে টোপ রেখে ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছে রসিকপুর। রসিকপুরের কোথাও এবার রাজনৈতিক প্রচার নেই। যে দু’-চারজন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তারাও জমাটবাঁধা বিক্ষোভের সামনে মিইয়ে আছে। তবু তাদের হাত ধরেই নন্দগ্রাম থেকে নেতারা এলেন। একদিন শাসক, একদিন বিরোধী। তারা এলেন জালালের নৌকাতে চেপেই। প্রাইমারি স্কুলের মাঠে ভেঙে পড়ল রসিকপুর, দু’দিনই। দু’দিনই নেতারা বোঝালেন, এখন নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গেছে, তাই নতুন কাজ শুরু করা যাবে না। তবে ভোটে জিতে এলে এই সেতু যে তারা বানাবেন, তার প্রতিশ্রুতি দিতে ভুললেন না। গ্রাম সমস্বরে জানিয়ে দিল, এই প্রতিশ্রুতিতে ভবি ভুলছে না। এমন প্রতিশ্রুতি আগেও বহুবার দেওয়া হয়েছে। তাই এবার— ব্রিজ নাই তো ভোট নাই। নেতারা ফেরত গেলেন জালালের নৌকাতেই। উত্তেজনার আঁচ জালাল অনুভব করতে থাকে বেহুলার ধারে বসে। ঘুনিতে ধরা পড়া মাছের মতো খলবল করতে থাকে ওর মনটা। গরম বাড়তে থাকে। অস্বস্তি বাড়ে ওর। একটু শীতলতার আশ্রয় খোঁজে।
জালালের নৌকাটা যেন নৌকা নয়, একটা বার্তাবাহক। ওর নৌকা বেয়েই বিদ্রোহ ভেসে যায়, জমাট বাঁধতে আসে ক্ষোভ প্রশমনেরা। এমনই একদিনে দলবল নিয়ে জালালের নৌকা বেয়েই রসিকপুরে হাজির হলেন স্বয়ং বিডিও সাহেব। ক্ষীণস্রোতা বেহুলা এত স্রোত নিজেকে চিরে আরপার করতে কখনো দেখেনি। বয়সে ন্যূব্জ নদীতে এখন ঢেউ ওঠে না। তবু নন্দগ্রাম থেকে রসিকপুর উত্তেজনার ঢেউ পারাপার করে। প্রশাসনিক আশ্বাসেও বরফ গলল না। বিডিও জানিয়ে গেলেন ভোটের দিন সব ব্যবস্থাই থাকবে। ইচ্ছুক ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন। কেউ ভোটদানে বাধা দিলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঘর্ষণ যত বেশি হয় উত্তাপও তত ছড়াতে থাকে। থার্মোমিটারের পারদ ছত্রিশ ছুঁইছুঁই। বিডিও আসার দিনই জালালের হাতে এসে গেল ভোটের তিনদিন সরকারি স্তরে নৌকা ভাড়া নেওয়ার চিঠি। প্রতিবারই আসে। প্রতিবারই ভোটকর্মী থেকে পুলিশ বেহুলা পারাপার করেন জালালের নৌকায়। এবার রাজনৈতিক লড়াই এখানে না থাকলেও, ঘর্ষণ তীব্র; তাই উত্তাপও বেশি। বিডিও সাহেব যেন গ্রামটাকে সম্মুখসমরে দাঁড় করিয়ে গেলেন— ভোট দিতে ইচ্ছুক ও ভোট বয়কটকারী।
জালালুদ্দিন শেখের বড়ো গরম লাগে। সে একটু শীতল ছায়া খোঁজে। ভোট বয়কটকারীরা পোস্টার মারে, মাইকে ফুঁকতে থাকে। বলতে থাকে— ব্রিজ দিয়েই উন্নয়ন আসবে। পোয়াতি মা ব্রিজ দিয়েই হাসপাতালে যেতে পারবে। কুটুমবাড়ি যেতে পায়ে কাদা লাগাতে হবে না। বেহুলার বুকে লগি গেঁথে নৌকা ঠেলতে ঠেলতে সব শোনে জালাল। ভাবতে চায় না এসব নিয়ে। ভাবতে গেলে জালালের ক্লান্তি লাগে। বুঝে উঠতে পারে না কিছুই, সিদ্ধান্তরা দূরে যেতে থাকে। তবু ভাবনারা জড়ো হয়েই যায়। অন্ধকার ঘনালে বাড়ি বাড়ি হানা দেয় চুপ করে থাকা রাজনীতির কারবারিরা। বোঝায়, ভোটটা দরকার। ভোট হলে তবেই ব্রিজ হওয়া সম্ভব। জালালের কাছেও এসেছিল ওরা। বলে গেছে, ব্রিজ হলে জালালের নৌকা কেউ চড়বে না। রুটিরুজি বন্ধ। বেহুলা আর ব্রিজ নিয়ে কোনোদিন না ভাবা জালাল এখন ভাবে। ভাবে স্বার্থের কথা, বেঁচে থাকার কথা।
ভোট বয়কট সমর্থনকারীরাও এসেছিল জালালের কাছে। আবদার, বলা যায় দাবি নিয়ে। হাতজোড় করে বলেছিল ভোটকর্মীদের আনার জন্য নৌকা ভাড়া যেন ও না দেয়। দিলেই পুলিশ রসিকপুরে ঢুকে যাবে। তারপর জোর করে ঘর থেকে বাসিন্দাদের তুলে নিয়ে ভোট দেওয়াবে। ভোট করানো যে প্রশাসনের কাছে চ্যালেঞ্জ। নৌকা ভাড়া দিলে জালাল রসিকপুরের কাছে গদ্দার হয়ে যাবে। শেষ বাক্যটা কাটা কাটা, অতি শীতল। জালালুদ্দিন শেখ এখন ভাবে। গরমে ঘামতে ঘামতে, শীতলতা খুঁজতে খুঁজতে নিজের ভালো-মন্দ ভাবে। সিদ্ধান্ত খুঁজে পায় না, তবু ভেবে চলে। দুটো মতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে জালালুদ্দিন শেখ। ও যেন নিজেই একটা সেতু। ওঁর ভালো-মন্দ সব ঝাপসা হয়ে পড়ে আছে শুধু দুটো মতের দ্বন্দ্বটুকু। সরকারি আদেশ পালন না করার মূল্যটা জানে জালাল। ওঁর ঘাটের ডাক বাতিল হয়ে যাবে। নিজের পেশাটুকু নিজের হাত ছাড়িয়ে চলে যাবে। আর পালন করলে গ্রামে একঘরে হতে সময় লাগবে না। বড্ড গরম লাগে জালালের।
ভোটের আগের দিন দুপুরটা বড্ড খাঁখাঁ। গত দু’দিন বৃষ্টি হয়েছে তবু সূর্যের তেজ দেখে তা বোঝা দায়। রসিকপুরের বাড়িতে গরুকে জাবনা দিচ্ছিল জালাল। এই সময় নন্দগ্রামের দিক থেকে ডাকাডাকি শুরু হল। নদী খুব বেশি চওড়া নয়, এপাড়-ওপাড়ে ডাক দিলে শোনা যায়। ও বেরিয়ে এসে দেখল ওপাড়ে ভোটকর্মীদের সঙ্গে বেশ কয়েকজন পুলিশ। হাঁকডাক শুনে পাড়ে ভিড় জমিয়েছে গ্রামবাসীরাও, বেশিরভাগই ভোটবয়কটকারী। ওদের দিকে তাকায় জালাল। ওদের চোখে না যাওয়ার আকুতি। জালাল হাতে বিডিও-র চিঠিটা নিয়ে দেখে। মন শক্ত করে। লুঙ্গিটা ভাঁজ করে কোমরে বাঁধে। তারপর রশি খুলে লগিতে চাপ দিয়ে নৌকা ভাসিয়ে দেয় জলে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। তবু জালালের কানে রসিকপুরের হেরে যাওয়ার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ যেন ভেসে আসে। ভেসে আসে নন্দগ্রামের দিক থেকে উল্লাস-ধ্বনি। কোথাও কোনো উত্তেজনা নেই। তবু উত্তেজনার উত্তাপ জালালের গায়ে ছ্যাঁকা লাগায়। জালাল শীতলতা খোঁজে। আকাশে সূর্যের দিকে তাকায়। ঝলসে যায় চোখ।
দু’ পাড়ে মানুষ ঠায় দাঁড়িয়ে। নৌকা মাঝ বেহুলায়। হঠাৎ নৌকার নীচের তক্তা সরে জল ঢুকতে শুরু করে। পেরেকটা যেন বেশিই তোলা ছিল। গ্লবগ্লব শব্দে জল দখল নেয় নৌকার পেটের। ডুবতে থাকা নৌকায় বসে জালালুদ্দিন শেখ অপেক্ষা করে বেহুলার শীতলতার। গরম হতে থাকা জলের উপরিতল পার হলেই গভীর শীতলতা। সেখানে ভাবনা নেই, সিদ্ধান্ত নেওয়ার জটিলতা নেই।
জালালের পেতে রাখা ঘুনিতে ধরা পড়া মাছেরা শুধু খলবল করে ওঠে।
'জালাল নিজেই যেন একটা সেতু'। এই একটি বাক্যতেই যেন গল্পের মেজাজটা ধরা রয়েছে। দ্বিধা দ্বন্দ্ব, ভালো-মন্দ, ঠিক বেঠিকের টানাপোড়েনে জেরবার এক 'সাধারণ' নাগরিকের মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রকাশ দেখতে পেলাম। শেষটা কিছুটা হতাশার, কষ্টের, হয়তো এ ছাড়া আর কিছুই হওয়ার ছিল না, হয়তো অন্য কিছু হলেও পরিণতি একই হত, হয়তো...
ReplyDeleteভালো বললে সপ্তর্ষি।
ReplyDeleteগল্পটা ভালো লাগল চমক।
ReplyDeleteঅসাধারণ গল্প। এমন গল্প পাঠকের প্রাপ্তি। মুগ্ধ হলাম বিশেষত শেষটায়। আপাত নিরপেক্ষ অথচ নিয়তি।
ReplyDelete