বাক্‌ ১৪৫ ।। আবেশ কুমার দাস

 

 

 

ফিঙ্গারপ্রিন্ট

 

আর-একবার ধুয়ে আসুন তো স্যার হাতটা।

          এই তো ধুলাম...

          তাও নিতে পারছে না মেশিন, আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট। আচ্ছা, রিং ফিঙ্গারটা দেবেন তো। আরে, টেবিলের ওপাশে হালকা বিরক্তি, রিং ফিঙ্গার... আই মিন এই আঙুলটা...

          কাচের ছোট্ট পর্দায় অনামিকাটাকে প্রাণপণে চেপে ধরেন হিরণ্ময়

          এল?

          উঁহু, একইরকম। রেকগনাইজ করতেই পারছে না মেশিনমুশকিল হল...

          কী হবে এখন? সিমটা...

          বুঝতে পারছি না। এরকম তো দেখিনি কখনওভীষণ ড্রাই স্কিন আপনারকোল্ড ক্রিম ইউজ করেন...

          অসমাপ্ত বাক্যটা আসলে প্রশ্নসূচক। বোঝেন হিরণ্ময়শীতে ক্রিম মাখেন কিনা তার জমাখরচও দিতে হবে এই হাঁটুর বয়সি মেয়েটাকে! রাগ হয় হঠাৎ। বন্ধ হয়ে যাওয়া সিমটা সচল হওয়া-না হওয়ার সঙ্গে এসবের কী সম্পর্ক! বেশ তো চলছিল। পরিষেবা বন্ধই বা হল কেন!

          মুখ দেখে বোধহয় কিছু টের পেল সেই সাদা শার্টবলল, বুঝতে পারছি স্যার প্রবলেমটা। আসলে সিম রিলেটেড ক্রাইম ঠেকাতে এই স্টেপটা নিয়েছে এখন কোম্পানি। আধার জমা পড়লেই ফের চালু হয়ে যাচ্ছে সার্ভিস...

          সে শুনলাম আমরা, এবার মুখ খোলে আদিত্য, যে দোকান থেকে নেওয়া হয়েছিল সিম, ওরাই কাগজ নিয়ে আসতে বলল মিনি স্টোরে...

          রাইট। কিন্তু উনিই যে হিরণ্ময় দত্ত, বোঝা যাবে স্ক্যানড ফিঙ্গারপ্রিন্ট আধার ডেটাবেসের সঙ্গে মিললে। আর মেশিন এই মুহূর্তে স্ক্যান করতে পারছে না ওনার আঙুলের ছাপ...

          মনে মনে বলেন হিরণ্ময়, তাই ক্রিম মাখার জমাখরচও দিতে হবে এখন তোমার কাছে...

          সেই আমলের মানুষ হিরণ্ময়, যখন মধ্যবিত্ত পরিবারে পুরুষের সাজগোজের বিলাসিতাকে দেখা হত বিদ্রূপের চোখে। কিন্তু... ব্যাঙ্ক, লাইট অফিস, গ্যাস বুকিং সব জায়গায় দেওয়া রয়েছে এই বন্ধ হয়ে যাওয়া নাম্বারটাই...

          আর তাঁর রুক্ষ্ম আঙুলের ছাপ আজ অপাঙ্‌ক্তেয় ডিজিটাল যুগের মেশিনের কাছে।

          আদিত্যই কথা চালাতে থাকে, এখন কী করা যায় ম্যাডাম...

          ছেলেটার গলাটা একটু বেশিই বিনীত লাগছে না কানে! গগলসটা পরে থাকাও কি খুব দরকারি ঘরের মধ্যে!

          এক কাজ করুন। নাম্বারটা আপনার নামে চালু করে নিন আপনার আধার দিয়ে। আছে সঙ্গে? ফাইন, তাহলে ফটোকপি করে আনুন। আর তাহলে পোস্ট পেড করতে হবে কিন্তু...

 

অতএব, আইনত হস্তান্তর ঘটে যায় একচিলতে সম্পত্তিটুকুর।

 

 

 

 

বীজ

 

লং শট: পর্দাজোড়া অন্ধকার। দূরে আলোর আভাস...

          মিড লং শট: জ্বলমান চিতা। কয়েকটা লোক...

          ক্লোজ শট: গায়ের উর্দিতে চেনা যায় লোকগুলোকে...

 

যা বললাম। এই টার্মটা কিন্তু অবশ্যই রাখবেন। ইন্টেলেকচুয়াল মাস্টারবেশন...

          কিন্তু তাহলে কি ধরে নেব বুদ্ধিজীবীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস নেই অলোক বটব্যালের?

          আছে। শুধু বুদ্ধিজীবী নয়, যে কোনও মানুষের বাক্‌স্বাধীনতাতেই আছে বিশ্বাস। কিন্তু কিছু বুদ্ধিজীবীর উদ্দেশ্যটা যদি হয় এটা-সেটা যুক্তি দেখিয়ে বারেবারে জলটাকে ঘুলিয়ে দেওয়া...

          বুঝলাম। কিন্তু অপযুক্তি বা কুযুক্তি হলে তো মানুষই ছুঁড়ে ফেলবে মতটাকে...

          মানুষ? দেখুন... এক মিনিট, অফ করুন টেপটাহ্যাঁ দেখুন, আপনার এই মানুষ বা বাংলা সাহিত্য কিন্তু সংসার চালায় না আমার। ঠিক আছে? আমার মেয়ের স্কুলের ফিজটাও ওঠে না ওতে গল্প-উপন্যাস লিখি শখে। প্রফেশনাল লাইফে একটা এমএনসি-র বেশ উঁচু পোস্টই হোল্ড করি আমি আর আমার ওই রূপটা কল্পনাও করতে পারবেন না এ-ঘরে বসে। অ্যান্ড আই এনজয় দ্য কর্পোরেট পলিটিক্স আ লট। ঠিক আছে? নীতিটা কী জানেন তো আমাদের? স্রেফ হায়ার অ্যান্ড ফায়ার...

          কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থা কোনও এমএনসি নয়। আর মানুষের রায়ে নির্বাচিত একটা সরকার...

          এক মিনিট। এক মিনিট। শুনুন, ক্যামেরার সামনে ডেফিনিটলি বলা যাবে না এসব। কী জানেন তো, একশো উনচল্লিশ কোটি মানুষের দেশে একশো উনচল্লিশ কোটি থিয়োরি একজিস্ট করতেই পারে। কিন্তু দেশ চলবে একটাই থিয়োরিতে। এবং সেটা জ্যান্ত মানুষকে গ্যাস চেম্বারে ভরার থিয়োরি হলেও আপত্তি নেই আমার। প্রোভাইডেড যদি বিকাশ ঘটে তাতে দেশের। মনে রাখবেন এই মডেলে চলেই একটা মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়া দেশ একুশ বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার গিয়েছিল বিশ্বযুদ্ধে। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অবধি জ্বলে ওঠে আমার যখন দেখি কিছু বুদ্ধিজীবী বন্ধুকে ইন্টেলেকচুয়াল মাস্টারবেশনে এই পুরো ছকটাকেই ঘেঁটে দিতে...

 

কী পুড়ছে ওখানে?

          ...আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে নয়।

 

ছ’ দশক আগের মতোই ছবিটার নাম ‘মাদার ইন্ডিয়া’

          সাক্ষাৎকারটা অবশ্য সিনেমার ফ্রেম থেকে নেওয়া নয়।

 

 

 

 

ক্রীতদাস

 

ব্লু রে-র যুগে গ্রামোফোনের গল্প হয়ে যাচ্ছে না এবার! সেই বাবুই আর চড়াইয়ের মতো কথা বলছ তো দেখছি...

          বাবা! তোমার মনে আছে কবিতাটা!

          না থাকার কিছু নেই তোভাল রেজাল্ট করেই উঠতাম পরপর ক্লাসে। ওই বয়সে বাংলায় তোমার থেকে বেশি মার্কসই পেয়েছি বরাবর। তাই তো আমি লাগালাম আইআইটি। আর তুমি ঘষটালে সেই বঙ্কিম কলেজে। তাও যদি ব্যাঙ্ক বা রেল বাধাতে পারতে একটামানছি না মানব না’-র দলে ভিড়ে গেলে কলেজে ঢুকেই...

          আর তুমি! সেই কথাই বলতে হয় ঘুরেফিরে। কর্পোরেটের ক্রীতদাস। রিপোর্টার ডেকে দশটা কথা বলতে পারি প্রকাশ্যে। তুমি কৃষিবিলের বিরুদ্ধে একটা শব্দ লিখতেও ভয় পাও আজ ফেসবুকে। দাঁড়াও না, চব্বিশে ঘুরে আসছি আমরাই...

          দেখো, তোমরা চব্বিশ না হোক চৌতিরিশে হলেও যে আসছ, বোঝে আমাদের মালিকও। যা শুরু করেছে এরা! কিন্তু তুমি কি ভাবো ক্যাম্পেনিং লাগবে না তোমাদেরও! তখন! যত নীচু লেভেলেই হোক, পার্টিটা তো করো। ভোটের যে একটা খরচা আছে বোঝো...

          এবার চুপ করে যায় একদা বঙ্কিম কলেজের বাংলা অনার্স।

          সুতরাং, বাংলা অনার্সের কাঁধে হাত রাখে আইআইটি খড়গপুর, আমিও যেমন, তুমিও সেই ক্রীতদাসই। সেদিনের বিলগুলোর কথা উঠলে আবার তালা পড়ে যাবে তোমার মুখে। বেগরবাই করলে আজ যে রাজার হয়ে এত ঘাম ঝরাচ্ছ, সে-ই সাসপেন্ড করবে সেদিন দল থেকে...

          এটা অবশ্য মন্দ বলোনিযন্ত্রপাতি নিয়ে নাড়াচাড়া করলেও নিজে যন্ত্র হয়ে যাওনি দেখছি একেবারে...

          হাসে একদা উজ্জ্বল আইআইটি খড়গপুর। অল্প বয়সের স্বরূপ দত্তর মতো সুন্দর আজও হাসিটা।

তাহলে ক্রীতদাস হওয়াই যখন নিয়তি, সেই কর্মফলেই দু’জনেই জন্মেছি এই পোড়া দেশে, যার যার রুচিতে একটু ভাল থাকার চেষ্টা করতে ক্ষতি কী বলো! যাক, কতকাল পর দেখলাম তোমায়! যেতে বলবে না বাড়িতে!

          ‘যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়’...

4 comments: