"আসলেই জানি না। আসলে প্রতিটি সার্থক কবিতার জন্ম তার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত স্থির কবিতার সব সংজ্ঞার ধ্বংসস্তূপের ওপর।
এই মুহূর্তে যা মনে হচ্ছে, লিখছি। কবিতা তা–ই, ভাষা যেখানে নতুন ভাব শিকার করতে গিয়ে তার সব চিহ্ন হারিয়ে ফেলে। যেখানে অবগাহন করে ভাষার নবজন্ম ঘটে। যার সামনে আমাদের চেনা সব সীমানা ভেঙে পড়ে।"
সাজ্জাদ শরিফ ('কবিতার সংজ্ঞা')
কবি কে? প্রশ্ন রাখলে যিনি উত্তর দেন - "ভাষার জাল ফেলে যিনি অজ্ঞেয়কে ধরেন", সেই কবিকেই 'বাক্ ১৪৫' উপস্থাপন করতে পেরে সম্মানিত 'এই সংখ্যার কবি' হিসাবে। (সোনালী চক্রবর্তী। বিভাগীয় সম্পাদক)
সাজ্জাদ শরিফের জন্ম পুরোনো ঢাকায়, ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৬৩ সালে। শৈশব-কৈশোর কেটেছে পুরোনো ঢাকার অলিতে-গলিতে। কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ১৯৮০-র দশকে। লেখালেখির বড় অংশ প্রকাশিত হয়েছে অনিন্দ্য,গাণ্ডীব,সংবেদ ইত্যাদি ছোটকাগজে। বিভিন্ন সাহিত্যপত্র ও দৈনিকেও লিখেছেন। কবিতা প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক সাহিত্যপত্র ও সংকলনগ্রন্থে। কবিতা অনুদিত হয়েছে একাধিক ভাষায়। অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ডব্লিউ ডব্লিউ নর্টন অ্যান্ড কোম্পানি প্রকাশিত ল্যাংগুয়েজ ফর আ নিউ সেঞ্চুরি: কনটেম্পোরারি পোয়েট্রি ফ্রম দ্য মিডল ইস্ট, এশিয়া অ্যান্ড বিয়ন্ড (২০০৮) এবং জার্মান সরকার প্রকাশিত পোয়েটস ট্রান্সলেটিং পোয়েটস (২০১৬) গ্রন্থে। নিজেও অনুবাদ করেছেন। প্রবন্ধ লিখেছেন ও বক্তৃতা দিয়েছেন বিচিত্র বিষয়ে। কবির প্রিয় কবি বাংলা ভাষায় রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র আর জীবনানন্দ দাশ। বাইরে ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা।
প্রকাশনা সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা, বিমা কোম্পানি ইত্যাদিতে পেশা বদলের পর থিতু হয়েছেন সাংবাদিকতায়। বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরতন্ত্র অবসানের পর, ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ থেকে, একাধিক দৈনিকে কাজ করেছেন। এখন প্রথম আলো-র ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।
গ্রন্থপঞ্জি
১| "ছুরিচিকিৎসা" (২০০৬),
২| "যেখানে লিবার্টি মানে স্ট্যাচু" (২০০৯),
৩|"রক্ত ও অশ্রুর গাথা" (২০১২),
৪|"আলাপে ঝালাতে" (২০১৯),
৫| "সোলেমানগীতিকা" (২০১৯)
সম্পাদিত বই একাধিক। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বেরিয়েছে রণজিৎ দাশের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদিত সংকলনগ্রন্থ "বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবিতা" (২০০৯)।
আটটি পুরোনো কবিতা
প্রতিবেশী
এইঘুমন্ত নিচু গ্রামে
হাওয়াএলোমেলো, বিদেশিনী
তাকেভাষাহীন সংকেতে
আমিচিনি না বা ঠিক চিনি
দূরেদিগন্ত কাঁটাতার
দূরেমেঘে মেঘে মশগুল
সাদাউড়ন্ত মিনারের
নিচেএকাকিনী লাল ফুল
বলোওগো প্রতিবেশী ফুল
হাওয়াতোমার কি সন্তান?
তারঅবোধ্য সংকেতে
প্রাণেজ্বলে ওঠে আরও প্রাণ
তুমিনর্তকীমুদ্রায়
কেনদিচ্ছ অপ্রণামি?
কেউবুঝি না তো এই রাতে
তুমিতুমি, নাকি তুমি আমি
তবুভূগোলের সিলেবাসে
আজওএ কথা পড়ানো হয়:
এইরাতজাগা উঁচু গ্রামে
হাওয়াপ্রসঙ্গক্রমে বয়
চাঁদে পাওয়া গাছ
নিষেধ শুনলে না
তুমি
পাখা মেললে রাতভর
উড়ে গেলে
এদিক-ওদিক
তুমি
আমাকে নাওনি পিঠে
ও শ্যামল
দীর্ঘ দেবদারু
তুমি
শুনলে যমের কান্না
রাতপ্রহরীর সিগন্যালে
আর
চোখে দেখলে অতীতের
সব লাশ
জ্যান্ত হয়ে
উঠে আসছে আগামীর থেকে
তুমি
বৃক্ষ হতে
চাইছ না আর
শুধু
আমি আজ
তোমার শেকড়
থেকে
জন্ম নিতে চাই
অন্ধ শিকারি
ভাঙাঅন্ধের লাঠি হাতে
আমিশিকারের সন্ধানে
চলিদিগন্ত পার হয়ে
ডানা
কেমন ঝাপটে এলে, ডানা, এই জলাভূমি থেকে
আমাকে নখরে গেঁথে, ও স্বতঃপ্রকাশ,
তুলে নেবে? রাত্রি এলে কেন দূর বনে চলে গেলে
অচেনা জন্তুর ঘায়ে ন্যুব্জ হয়ে থাকি, আমি জলে ডুব দিয়ে
কাটাই দিবসযাম। হাঙর আমার
বাবা-মাকে খেয়ে নিল, আমি তো অনাথ, আমি শ্যাওলার ঝোপে
লুকিয়ে বেঁচেছি এতকাল
আমার শরীর থেকে খসে, ডানা, অপরহরণে
চলে গিয়েছিলে যদি হাওয়াকে পাঠাই খোঁজে, ঝড় আমার ছেলে
জন্তুর খুরের তৃণে বিষ্ঠা ও লালায়
ভরেছে সমস্ত দেহ; নিজে নিজে, ও ডানা, ফিরেছ তুমি আজ
বাঁকানো নখর নিয়ে এ জলাভূমিতে কেন বলো?
নিঘুমজাগর আমি দিগ্ব্যাপী এ জলপাতালে
দেখছি উঠছে জেগে সমাধিমহল—
একটি সে খালি, তাতে মনুষ্যচর্বির দীপগুলো
জ্বলে উঠছে একে একে, আমাকে কী বেছে নিতে বলো
ও ডানা, ও পুনরাগমন?
উপাখ্যান
যে দ্বীপে বসত করি তার নাম ক্ষণপরিত্রাণ
সীমানানির্দেশ দেখে ভীত নাবিকেরা
জাহাজ ফিরিয়ে নেয়। এই দ্বীপ ছয় মাস মোমসমুদ্রের
মধ্যে ভেসে থাকে আর বাকি ছয় মাস
অগ্নিপরিখার পেটে। মেঘ এসে উদরে চেপে রাখে
ধাতুর ডিমের মতো এই জতুগৃহ, এর ঘন কালিমার
ক্রন্দন-আকুল দিন-বেদনাশিখর
কখনো হঠাৎ ঝড়-কোমরে পালক গোঁজা দ্বীপবালিকারা
ফেনার জোয়ারে ভাসে। মানুষের বীজ
দু পায়ে থেঁতলে দিয়ে অতিকায় দানো
দাঁড়ায় সামনে এসে; আরও চায় ভোগ, করোটির
পাত্র ভরে আরও চায় পানীয়, ক্ষরণ
কী আছে আমার, বলো, প্রসারিত দুই হাত ভরে
তোমাকে কী দেব আর? দেহের কলম
পারিনি লালন করতে, দাওনি সুযোগ, দেব, তোমায় তোষণ
এতই কঠিন, তাই অবশিষ্ট বীজ
ভাসিয়ে দিয়েছি আমি তরঙ্গশীর্ষের জলে জলে
অন্নপ্রাশন
মড়াটানা চৌকিতে ভরে উঠছে অন্নপ্রাশনের দিন
পা পেঁচিয়ে গরুর নাড়িতে হুমড়ি খাচ্ছে এদের শিশু ওদের শিশু
বস্তুত খালি খামই পোস্ট হয়েছে ক্রমাগত ভুল ঠিকানায়
গভীর জ্যোৎস্না
তাতে জটিল হয়ে পড়ল কথাবার্তা, মুখ দেখাদেখি
মফস্বল থেকে কলকলিয়ে আসছে বেশ্যারা
মাজারে তাদের মানত, সন্তানভাগ্যের
যেন নিজেরই কাঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সবাই রেলিং থেকে
ধোঁয়াবাগানের মধ্যে গান গাইছে স্কুলছাত্রীরা ভর সন্ধেবেলা
টেনে আনছে শঙ্কর শঙ্কর
বাতিল কাগজে পূর্ণ হয়ে গেছে আমাদের বৈঠকখানা
শুধু গত মেলায় মুখোশ কিনে উপহার দিয়েছি বন্ধুদের
বুদ্ধপুর্ণিমায় শাণিয়েছি ধর্মনিরপেক্ষতার চাকু
আসলে মরা চোখ থেকেই ঠিকরে পড়ছে অতর্কিত দ্যুতি
যেমন হেস্টিংসের ভূত চলে যেতে
‘বাঙ্গালা মা, বাঙ্গালা মা’ কেঁদেছিল নীলকৃষকেরা
বন্দী
ছেড়ে দে, আর নয়; কী জেদে তবে আর বাঁচানো?
পাতালকুঠুরি না, সিংহ ভরে রাখা খাঁচা নয়,
যেখানে রেখেছিস অন্ধ পচা ডোবা—রাতদিন
জলকামড় লাগে বাড়িয়ে যেখানেই হাত দিই।
উঠতে দেখি রোজ আকাশে ফাঁপা ক্ষয়া ধড়কে—
সূর্য বলে লোকে, জানি না ওর সম্পর্কে
এর চে’ বেশি কিছু। ছেড়ে দে, ছেড়ে দে রে আমাকে
আঙুলে কেন ছুঁচ, কেন বা চোখ-নাক তামাকে
জ্বালিয়ে দিস তুই। পালিয়ে এ বিভূঁই শান্তি
মরেছে ফাঁসি দিয়ে; ভল্ল আন তবে, আন তির
কেটে নে এ শরীর, কেটে নে ঘ্রাণ আর গৌরব
ঢেলে দে ক্ষার ধীরে চুল্লি জ্বালা শিরে সৌর
গিয়েছি যদি ডানে আদরে চুম্বনলালাতে
ভস্ম করেছিলি, গিয়েছি বাঁয়ে যদি পালাতে
ছদ্মছলে ফের ভিন্ন রূপে তুই মস্ত
দাঁত আড়াল করে আসিস; খিদে রাক্ষস তোর
কেন রে বল দেখি? কীভাবে যাবে আর এগোনো?...
শোনো হে বায়ুচর, রাশির কম্পন যে গোনো,
যা দ্যাখো টুকে রেখো পাথরে প্যাপিরাসে দলিলে।
থাকতে হবে, থাকি, আমিই এই পাঁকে সলিলে।
ঘোড়া
ঘন রাত, আর শুধু ডানাহীন ওড়া
সদ্গুরু
পরের জন্যে গড়েন প্রাসাদ ফুলের বাগিচায়
নিজ বাড়ি রাস্তায়
দু টুকরো চাঁদ একটি জটায় অন্যটি তাঁর হাতে
অমাবস্যা রাতে
তিনি তো সদ্গুরু আমার মৃত্যুযমজ ভাই
তাঁরই কাছে ঠাঁই
হাত ধরে যান নিয়ে যে পথ সবার জন্যে মানা
নিজের দু চোখ কানা
দশতলা-বিশতলা আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পরে
ঢোকেন তার ভেতরে
গেলেন যেন আপন নিবাস এমন সৃষ্টিছাড়া
বওয়ান ঝরনাধারা
পায়ের গর্ত থেকে ভুখা আগুনশর্ত থেকে
শিখারা যান বেঁকে
গেলাসভরা জলকে মধু করেন শুধু ফুঁয়ে
বৃক্ষ জাগান ভুঁইয়ে
তিনি আমার রক্তপিতা স্বপ্নজাতিস্মর
তাঁর ভেতরে ঘর
বানিয়ে থাকি কিন্তু মরেন যখনই সদ্গুরু
ভণিতা হয় শুরু
'বাক্ ১৪৫'-এর জন্য দুটো নতুন কবিতা
কথার ওপারে
কথার ওপারে যেতে চাই
সবই দেখি অর্থময়, সবকিছু প্রবল বাঙ্ময়—
যা কিছু সচিহ্ন তার সবটাই সশব্দ হুঙ্কার
হয়ে উঠছে, ভাসিয়ে লোপাট করছে সমস্ত সংসার।
কোথায় সে হ্রদ যার চিরস্থির জলে
ঢিল ছুড়লে তরঙ্গ ওঠে না?
নিরুচ্চার, তুমি জেগে ওঠো
আয়না
কেন্দ্রে শুধু আমিই একা
চতুর্দিকে সাজিয়ে রাখা আয়না
হাজার মুখচ্ছবির ভিড়ে
কোথাও আমার মুখটি দেখা যায় না
প্রতিটি কবিতাই অসম্ভব ভালো। এমন সব লেখা পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য 'বাক'-কে ধন্যবাদ।
ReplyDelete