জ্যান্ত দুর্গা
একভাবে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বড় বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে অজয়। ছ’-ছ’টা দিনের কনট্রাক্ট। সবে আজ প্রথম দিন, ষষ্ঠী। গভীর রাতে গলিপথ ধরে বাড়ি ফিরতে বেশ গা ছমছম করে। রাস্তায় তখন শুধু কয়েকটা কুকুরের সঙ্গ। এইটুকু রাস্তা এখন খুব লম্বা লাগে অজয়ের। বাড়ি ফিরতেই বউ কাঞ্চনাকে জিজ্ঞেস করে ওদের একমাত্র মেয়ে মিষ্টির কথা। অজয় কাজে গেলে মেয়েকে নিয়েই সময় কেটে যায় কাঞ্চনার। ক’দিন আগেই মিষ্টির সাত বছর পূর্ণ হয়েছে। জন্মদিনে মিষ্টি বাবার কাছে আবদার করে ওকে একটা বড় রিমোট কন্ট্রোল্ড পুতুল কিনে দিতে হবে। এই কথা শুনে অজয়-কাঞ্চনা মেয়েকে বোঝায় ওইসব খেলনা তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু মিষ্টির এক জেদ। পুতুল কিনে দিতেই হবে। শেষে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। পরের ক’টা দিন ভীষণ অভিমানে চুপচাপ ছিল মিষ্টি। অনেক হাসানোর চেষ্টা করেও হাসেনি সে।
কারখানায় অল্প মাইনের চাকরি করে এই বাজারে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। সকাল সকাল অজয়কে যেতে হয় কারখানায়। ফেরে সন্ধেবেলা। একদিন বাড়ি ফেরার পথে কাছের মিলন সংঘে যায় অজয়। এই সংঘ প্রতি বছর দুর্গাপুজো করে বেশ ঘটা করে। প্যান্ডেল, ঠাকুর তো আছেই, তাছাড়া বিশেষ কোনো না কোনো আকর্ষণ থাকেই। ইতিউতি তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে নিরাশ হয় অজয়। পেছন ঘুরতেই ডাক, আরে অজয়দা,তুমি!
অজয় ইতস্তত করে বলে, রণি ভাই, একটা খোঁজ নিতে এলাম। আগের বছর তোমাদের পুজোর প্যান্ডেল সাজানোর কাজে আমাকে নিয়েছিলে। এবারেও কি নেওয়া যাবে? আমার এক্সট্রা একটা কাজের খুব দরকার।
—কিন্তু অজয়দা, এবারে বাজেট কম গো! এবার কোনোরকমে পুজো হবে। আমফান বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণ দিতেই সব প্রায় শেষ। তবে এবছরও একটা ছোট্ট চমক তো থাকছেই।
—কী?
—জ্যান্ত দুর্গা!
—মানে?
—মানে আমরা এমন একজনকে খুঁজছি যে দুর্গা সেজে একভাবে বেশ কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে।
রণির হাত ধরে অজয় বলে, কাজটা আমাকে দাও ভাই। আমি সাজব।
—কী বলছ তুমি! তুমি দুর্গা... কিন্তু তুমি তো এইসব কখনও করোনি।
—আমি করব। পারব আমি।
অজয়ের গলায় আত্মবিশ্বাসের সুর। রণি বলে, ঠিক আছে। তবে ভেবে নাও, ছ’দিনের কনট্রাক্ট হবে, ষষ্ঠী থেকে একাদশী। পারবে তো?
কাজের ওভারটাইম করতে হচ্ছে বলে রাত হচ্ছে ফিরতে, এটাই বলে অজয় কাঞ্চনাকে। কাঞ্চনা ষষ্ঠীর দিন রাতে অজয় বাড়ি ফিরে খেতে বসলে বলে, মেয়েটা ঠাকুর দেখতে যাবে বলে বায়না ধরেছে।
—না, কোনো দরকার নেই। দেখছ না চারিদিকে কী অবস্থা! করোনা কীভাবে ছড়াচ্ছে। এটা করাটা ঠিক হবে না। ওকে বোঝাও।
—কিন্তু সবাই তো...
—যে যায় যাক। তোমরা যাবে না।
স্বামীর নির্দেশে মাথা নাড়ে কাঞ্চনা।
সপ্তমী যায়। অষ্টমী যায়। কোনোরকমে মেয়েকে বুঝিয়ে রাখে। কিন্তু নবমীর দিন আর সামলাতে পারে না মেয়েকে। মিষ্টি কেঁদেকেটে একাকার। মাকে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, মা, আজ নবমী হয়ে গেল। ঠাকুর তো কাল জলে চলে যাবে। চলো না নিয়ে আমাকে একবার ঠাকুর দেখাতে। বেশিদূর যেতে হবে না। কাছের ঠাকুরগুলো দেখব শুধু।
—কিন্তু বাবাই জানলে বকবে মা।
—বাবাই তো রাত করে ফেরে। আমরা তার আগেই তো চলে আসব। বাবাই জানবে না। চলো না মা, চলো না।
মেয়ের আবদার ফেলতে পারে না কাঞ্চনা। সাতপাঁচ ভেবে সম্মত হয়। সন্ধ্যাবেলা হালকা সেজে দু’জনে যায় কাছের প্যান্ডেলগুলোতে। চারিদিকে আলোর রোশনাই। মিষ্টি ভীষণ খুশি। শেষে যায় মিলন সংঘের পুজোর প্যান্ডেলে। ঠাকুর, প্যান্ডেল সাদামাটা হলেও এবারের প্রধান আকর্ষণ জ্যান্ত দুর্গা বেশ নজর কাড়ছে সবার। হাতে ত্রিশূল, পরনে শাড়ি, সেজেগুজে প্রায় নিষ্পলক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টি দেখে আনন্দে উচ্ছাসে ফেটে পড়ে। অনেকক্ষণ ধরে দেখতে থাকে মিষ্টি। মাকে জিজ্ঞেস করে, দেখো মা, একটা কী সুন্দর পুতুল! আমার এইরকমই একটা পুতুল চাই।
—ওটা একজন মেয়ে মা। পুতুল সেজেছে।
অজয়ের চোখ পড়ে মেয়ের দিকে। বুক দুরুদুরু করে। তবু সে অচল থাকে। মেয়ের মুখে হাসি দেখে চোখের জলকে সামাল দেয়।
দ্বাদশীর দিনই টাকা পায় অজয়। তার প্রশংসা করে সংঘের সবাই। বাহবা দেয়। অজয় তাড়াতাড়ি যায় বাজারে। একটা রিমোটচালিত বড় পুতুল কিনে বাড়ি ফেরে। পুতুল দেখেই মিষ্টির একগাল হাসি। যেন সারা বিশ্ব ওর পায়ের তলায়। মেয়েকে আদর করে অজয়। কাঞ্চনা অজয়কে জিজ্ঞেস করে, কোথা থেকে পেলে এত টাকা?
—ওভারটাইম করার জন্য দিয়েছে।
কাঞ্চনা একটু থমকে বলে, ত্রিশূল হাতে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ওভারটাইম করার জন্যই তোমার পায়ে এত ব্যথা। তাই না!
অজয় একটু বিস্মিত হয়। তারপর একগাল হাসি হেসে চুপ করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আকাশেবাতাসে যেন অনুরণিত হয়, ‘যা দেব সর্বভূতেষু পিতৃরূপেন সংস্থিত। নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।’
No comments:
Post a Comment