সময়
‘‘ইস্টেশনে ওই যে প্রথম শেডটা দেখতাসো, ওর তলেই তো একখান বেইঞ্চ আসিলো, ওর লগে যে চায়ের দোকানডা, ওইডাই খোলা পাবা। চলো, আমি চলি তোমার লগে।’’
—‘‘না... আমার পিছু খবরদার ধরবি না।’’
—‘‘উফ, একলা একলা মাইয়া মানুষ.... অখনে বাবু জিগাইলে কী কমু! আমারে যে কত্ত ভালোমন্দ কবেনে... তোমার আত্মায় ভয়ডর বলে কিছুই নাই কও! যাও, আমি খাড়ায় আসি।’’
অদিতিদেবী একটু হেসে বললেন, ‘‘মেয়েমানুষ? ওরে মানে মানে করে তো ষাটটা শরৎ পেরোলাম। এখন আর ভাদ্রের রোদে শরীর পুড়বে না। যা, অত ভাবিস না।’’
কিছু না বুঝে রিকশাওয়ালা হরেন মাথা নীচু করে মুখ বেঁকিয়ে কি যেন বিড়বিড় করতে লাগল।
অদিতিদেবী তাতে কান না দিয়ে তার পাশ কাটিয়ে নিজেই লাগেজ তুলে টিকিট কাউন্টারের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন। চারটে বাহান্নর ট্রেন। হাঁটুর ব্যথা, তাছাড়া কাল বৃষ্টি হয়েছে, কোথায় কী হয় সেই ভেবেই সর্বদা আগে বেরোনোর স্বভাব অদিতিদেবীর।
—‘‘ট্রেনটা লেট আছে জেঠিমা। চিনতে পারছেন আমি ঋজুর বন্ধু।’’
এদিক-ওদিক দেখে টিকিট কাউন্টারে ছেলেটা আবার বলল, ‘‘আপনি মনে হচ্ছে একা?’’
বেশ বড়সড় চোখ অদিতিদেবীর, চশমার ভেতর থেকে সোজাসুজি তাকালেন, ‘‘হ্যাঁ’’
—‘‘না এত ভোরে একা! আচ্ছা ওখানে বসুন, আমি আছি।’’
ছেলেটি টিকিটটা দিয়ে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবারও বলতে লাগলেন, ‘‘আমি অবশ্য ছয়টা অব্দি...’’
কথা শেষ হওয়ার আগেই টিকিট নিয়ে লাগেজ হাতে অদিতিদেবী স্টেশনের বাইরে পথে এগিয়ে গেছেন।
বয়স বাড়লেও ভদ্রমহিলার জেদ বিন্দুমাত্রও কমেনি। গটগট করে হাঁটতে শুরু করলেন সামনের দিকে।
আলো-আঁধারি শুনসান স্টেশন। কাকপক্ষী-ও নেই। বেশ কিছুটা দূরে সেই চায়ের দোকানটা দেখা যাচ্ছে। এখন আর শরৎকালের ভোরে কুয়াশা পড়ে না।
—‘‘হারান বোধহয় এটার কথাই বলেছিল।’’
এ তল্লাটে অদিতিদেবী নতুন নন। ছত্রিশ বছর আগে তিনি প্রথম পা রেখেছিলেন এই অজানা অচেনা শহরে। এক অচেনা মানুষের হাত ধরে বাবা-মায়ের অমতে চাকরিবাকরি মাথায় তুলে বেরিয়ে পড়েছিলেন কোন এক শীতের রাতে এক কাপড়ে তারপর থেকে ওই যে পথ চলা এখনও তা চলছে।
স্টেশনের সামনের দিকে যেতে যেতে একটু দাঁড়িয়ে পড়লেন অদিতিদেবী। হাঁটুর ক্ষয়। মনের শক্তি কি সর্বদা শরীরকে সঙ্গ দেয়! লাগেজটা রেখে চশমাটা ঠিক করে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন।
—‘‘আরে, এ তো আমাদের প্রণবের বাবার দোকান।’’
বিড়বিড় করে বলে রুমাল দিয়ে ঠোঁটের উপরে বিন্দু বিন্দু জমা ঘাম মুছে পুনরায় লাগেজ তুলতে যাবেন হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল।
একটি পাগলি মেয়ে। স্টেশনের একপাশে বসে খিলখিল করে হাসছে। না, পুরোপুরি উন্মাদ বলা চলে না। পাশে একটি বাচ্চা মেয়ে মোটামুটি দশ-এগারো বছর হবে চুপটি করে নোংরা একটা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।
পাগলি মেয়েটি অদিতিদেবীকে একবার আড়চোখে দেখে নিল। তারপর মাথা চুলকোতে চুলকোতে এমন সব ভাবসাব করতে শুরু করল যেন মনে হচ্ছে ও কিছু চাইছে। টাকা বা খাবার। পাশেই একজন কুলি, স্টেশনের বাঁধানো সিটে উবু হয়ে শুয়ে কোত্থেকে একটা কাশফুল তুলে এনে তার গায়ে একবার বোলাচ্ছে আবার শুয়ে থাকা বাচ্চা মেয়েটার মুখে একবার। পাগলি মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। তবে বাচ্চা মেয়েটি খুব রেগে যাচ্ছে মাঝেমাঝে বিরক্তও হচ্ছে।
অদিতিদেবীর মনে হল কুলিটাকে কিছু বলবেন তিনি। একটু থমকেও গেলেন কিন্তু কেউ কোথাও নেই দেখে কিছু যে বলবেন বা করবেন এমন সাহসও পেলেন না। অগত্যা এগিয়ে গেলেন চায়ের দোকানটার দিকে।
—‘‘দিদিভাই, চা-টা...’’
—‘‘হ্যাঁ, রাখ।’’
বৃষ্টির জলে শাড়ির কুঁচির নীচটা ভিজেছে, তাতে কিছুটা রাস্তার বালি আটকে গেছে। সেটিই ঝাড়তে ঝাড়তে সিটের একপাশে চায়ের কাপটা রাখে কাঁচাপাকা বেশ বড় একটা খোঁপায় লাগানো কাঁটাটা খুলে, দাঁত দিয়ে কাঁমড়ে, চুলগুলো হাতে পেঁচিয়ে নিলেন। পুনরায় খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বললেন, ‘‘বুঝলি প্রণব, আমার রিকশাচালক ছেলেটা ও আমায় নিয়ে বেশ চিন্তিত কিন্তু তুই-ই বল আমি তো এখানকার সব চিনি। সেই কোনকালে বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরের ভিটে এখনও ছাড়িনি কত ঝড় বয়ে গেল। ও বেচারা খামোখা ভয় পাচ্ছিল। আসলে আমার মতো বুড়ি এত ভোরে একা...’’
একটু হেসে চায়ের কাপটা তুলে সিটে বসে আবারও বললেন, ‘‘টিকিট কাউন্টারের ছেলেটাও বেশ ভয় পাচ্ছিল জানিস। আমি তাকেও তোয়াক্কাই করিনি কে আর কী করবে বল এই খোঁড়া বুড়িকে। ছেলের বয়সি ছেলে, ও নাকি আমাকে পাহারা দেবে।’’
হাসতে থাকলেন অদিতিদেবী।
—‘‘দিভাই দিনকাল ভালো নয়।’’
অদিতিদেবী বাঁ পায়ের উপর ডান পা তুলে হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, ‘‘এক জায়গায় বসতে পারি না রে প্রণব। পেসারটাও বেড়েছে। এখন ওষুধ খাই।’’
প্রণব একটু হেসে বলে, ‘‘ঋজু তোমায় বকা দেয় দিদি? দাদাবাবুর মতো? ও কি দাদাবাবুর মতো হল নাকি...’’
—‘‘বকে, ও আমাকে বকে বটে। আসলে কী জানিস, শিশু অবস্থায় মা-বাবারা ছেলেমেয়েদের যেমন করে আগলে আগলে রাখে, একটু বড় হলে প্রয়োজনে শাসনে সতর্ক করে, ঠিক বয়স বাড়লে ছেলেমেয়েরাও মনে করে মা-বাবা তাদের সন্তান।’’
একটু থেমে গেলেন অদিতিদেবী। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন, ‘‘অবশ্য এক্ষেত্রে তারা তেমন করে আগলে রাখুক আর না রাখুক, শাসনপ্রণালীটা সঠিক ভাবে বজায় রাখে। বরং একটু কঠোরই হয়। প্রণব, মেয়েজীবন থেকে নারীজীবন অব্দি অনেক তো মানলাম। মা হয়েও ছাড়লাম অনেককিছু। এখন বুড়ি, হয়তো কাল আর থাকব না এখন অতশত বাঁধন ভালো লাগে বল!’’
বড় বড় চোখগুলো বলতে বলতে একটু নিভু নিভু হয়ে আসছিল। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। পরনে ধূসররঙা শাড়ি। বাঁ হাতে ঘড়ি। ডানহাতে শাঁখা। কপালে একটি ছোট্ট টিপ।
শরৎকাল। বৃষ্টিভেজা কাশফুলের ভোর। প্লাটফর্মের ওপারের ডোবার ধারে মৃদুমন্দ হাওয়ায় কাশের দল মাথা নাড়ছে। অদিতিদেবী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
—‘‘মনে পড়ে প্রণব। তোর দাদাবাবুর সাথে এখানে এসেছিলাম। তখন বিয়ের প্রথম বছর। তোর বাবার হাতের চা প্রথম খেয়েছিলাম। সে ছিল এক শীতের সন্ধ্যা। সেদিনও এমনই বৃষ্টি, তুই তখন কত্ত ছোট।’’ একটু থেমে বলেন, ‘‘আচ্ছা ওপারের সেই মাংসের দোকানগুলি আছে? ডোবার জলটা তো পুরোপুরি রক্তে লাল হয়ে থাকত।’’
চা ঘোঁটাতে ঘোঁটাতে প্রণব বলে, ‘’‘হ্যাঁ দিদিভাই আছে। আবার অনেকদিন পর এলে। তবে তোমার দেখছি সব মনে আছে।’’
অদিতিদেবী মুচকি হাসলেন।
—‘‘ভুলতে পারিনি এখনও অনেক কিছু। ওই যে দ্যাখ, রক্তে রাঙানো ডোবার ধারে শরতের কাশফুল ফুটছে তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে অসময়ের বৃষ্টি...’’
অদিতিদেবী একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। প্রণব বলে উঠল, ‘‘আমি তো তোমাকে চিনতেই পারিনি জানো।’’
অদিতিদেবীর মুখে সর্বদাই হাসি লেগে থাকে।
—‘‘খুব বুড়ি হয়ে গেছি বল!’’
—‘‘না না, কী যে বলো, তোমার হাসিটা এখনও একই আছে। তোমরা দুইজনই খুব সুন্দরী ছিলে। মানিকজোড়। দিভাই, অলোকাদি জানো...’’
অদিতিদেবীর চোখ একনিমেষে কাশফুল থেকে সরে গেল প্রণবের দিকে। তার পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই কথার ওপর দিয়ে একপ্রকার আগ বাড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘‘তা প্রণব, বাবা কেমন আছেন তোর? আজ যে তুই দোকানে? ছেলেপুলে ক’টা? তুই তো সরকারি চাকরি পেয়েছিস।’’
প্রণব নিজের মতো নানা বাক্য যোগ করে আসল উত্তরগুলো দিতে থাকল।
অদিতিদেবী পাশের বেঞ্চে রাখা ম্যাগাজিনটা হাতে তুলে ধোঁয়া ওঠা সর পড়া মাটির ভাঁড়ে নীচু ঠোঁটে ফুঁ দিলেন। প্রথম চুমুক দিতে দিতেই সূচিপত্রে চোখ বুলিয়ে ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে দিলেন তিনি। ম্যাগাজিনটা দু’বছর আগের পুজোসংখ্যা।
—‘‘দিভাই ঘুম পাচ্ছে? এত ভোরে একা তো...’’
—‘‘না রে, বয়স হয়েছে। এখন ঘুমাতেও ওষুধ লাগে। আচ্ছা প্রণব আমি একটু পায়চারি করে আসি। লাগেজগুলো এখানে থাক। দেখিস।’’
বলেই চায়ের ভাঁড়টি পাশের ডাস্টবিনে চা ভরতি অবস্থায় ফেলে দিলেন তিনি। প্রণব আমতা-আমতা করে, ‘‘দিভাই, চা-টা বাবার মতো হয়নি বলো!’’
অন্যমনস্ক অদিতিদেবী ব্যাগ হাতড়ে কী একটা যেন খুঁজছিলেন।
প্রণব দ্বিতীয়বার যে জিজ্ঞাসা করবে তার সাহস পেল না। সে চায়ের কাপ ধুতে ধুতে ভালো করে নিরীক্ষণ করতে লাগল তার পরিচিত দিভাইকে।
—‘‘আজ দিভাই খুব অচেনা।’’
বিয়ের পর প্রণবই ছিল তার প্রথম ছাত্র। তখন সে খুব ছোট। অদিতিও নতুন বউ। নতুন জায়গা, নতুন নতুন মানুষ।
মায়ের মৃত্যুর পর প্রণবের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করাতে প্রণবের মামার বাড়িতেই আস্তানা হয়। তার বাবার ছোট্ট চায়ের দোকান। অদিতিদেবীর কাছে সে অনেক বছর পড়েছে।
ঋজু, অদিতিদেবীর অনেক বেশি বয়সের সন্তান। আগাগোড়াই ভদ্রমহিলা বাচ্চাদের খুব ভালোবাসতেন। এলাকায় খুব নামডাকও আছে। একা একটি আইসিডিএস স্কুলে বাচ্চাদের পড়াতেন। বাচ্চাগুলোর দেখাশুনো বলতে গেলে তাদের নিজের ঘরের ছেলের মতো দেখতেন। ভদ্রমহিলা ভীষণ স্নেহময়ী।
প্রণব এ-ও জানত এসব দাদাবাবু এক্কেবারে পছন্দ করতেন না। এইজন্যই দু’জনের মধ্যে সর্বদা দ্বন্দ্ব চলত। তবে দিদা মানে অদিতিদেবীর শাশুড়ি-মা তাকে যথেষ্ট সাহায্য করতেন।
প্রণবের মুখের হাসি একটু ম্লান হয়ে এল।
সামান্য কিছুতে উৎসাহিত করতেন যিনি, তিনি আজ প্রণবের চাকরি, বাড়ি, ছেলে, বউ এসব কথা শুনেও যেন শুনতেই পেলেন না। প্রণবের খুব মনে হল আজ দিদির উৎসাহের ভীষণ প্রয়োজন। সত্যি কিছু একটা হারিয়েছেন ভদ্রমহিলা। চোখেমুখে ভীষণ রাগ-বিরক্তি-বিষণ্নতা। কেউ যেন ভেতরে ঠুসে দিয়ে গেছে এক অদ্ভুত অসুখ।
আচমকা অদিতিদেবী প্রণবের দিকে তাকাতেই প্রণব মুখ ঘুরিয়ে নিজের মতো কাজ করতে থাকে। ম্যাগাজিনটা হাতে তুলে নিয়ে বলেন, ‘‘প্রণব এটা একটু নিলাম।’’
—‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ দিভাই।’’
—‘‘আমি, আমি প্রণব একটু পায়চারি করে আসি।’’
—‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ যাও।’’
অদিতিদেবী এগোতে যাবে। অমনি প্রণব অদিতিদেবীকে জিজ্ঞাসা করে, ‘‘দিদি দাদাবাবু এখনও অমন করে? তুমি লেখো এখনও?’’
—‘‘আচ্ছা প্রণব, তোর চায়ের দামটা দিয়ে যাই।’’
প্রণব কিছুক্ষণ চুপ থাকে। বুঝতে পারল দিদি এড়িয়ে যেতে চাইছে। সে সেই মুহূর্তে একগাল হেসে মজার ছলে বলে উঠল, ‘‘আরে তুমি তো এখানেই আসবে। যাও একটু ঘুরে আসো। আমি পালিয়ে যাব না। বেশি দূরে যেও না।’’
এগিয়ে গেলেন ধীরে ধীরে অদিতিদেবী।
ভোর তিনটে আটান্ন, জনশূন্য স্টেশন। স্টেশনের ওপারের ডোবাটার পাশ দিয়ে একটা গলি। ওই গলি দিয়ে নাকবরাবর গেলে সমান্তরাল দুটো বাড়ি। তার গা ঘেঁষে বাঁদিক লাগোয়া বারোয়ারি চণ্ডীমণ্ডপ। চণ্ডীমণ্ডপের পেছনদিক থেকে যে রাস্তাটা সোজা চলে গেছে ওটা ধরে একটু হেঁটে গেলেই দু’মিনিটের পথ অলোকাদের বাড়ি।
—‘‘এই এই এই। আস্তে, দেখ রে সামনে নোংরা। চোখ কপালে তুলে হাঁটিস নাকি।’’
—‘‘তুই তো আছিস। বড় বড় দুটো গোল গোল বাল্ব লাগিয়ে। ইশ্, আমি তোর জীবনে আসার পর তোর চোখে অভিশাপ লেগে গেছে।’’
—‘‘চল। ঘ্যানাস না। নজর খারাপ তোর।’’
—‘‘আমি ঘ্যানাই?’’
—‘‘স্বভাব তো, সুতরাং বুঝবি না।’’
—‘‘থাক... আর কিছু বলব না। সহজলভ্য হয়ে গেছি তো, চলে যাব, চলে যাব।’’
অলোকা প্রথমে হাসছিল হঠাৎ ‘চলে যাব’ শব্দটা শুনে সে ভ্রূকুটি করল।
—‘‘এই, সব কথায় কথায় ‘চলে যাব’, ‘থাকব না’ বলিস কেন রে?’’
—‘‘পাশে থাকলেও কাছে নয়। একদম না। খুঁটে খা।’’
—‘‘এই এই, তোকে কবে ব্যবহার করেছি রে যে খুঁটে খাওয়ার কথা বলছিস।’’
—‘‘ব্যবহার নয় তুই অতি বিজ্ঞ আর নিজেকে অতি চতুর মনে করিস। তোকে যে এম. এ-তে ভর্তি হতে বলেছিলাম, হলি এখনও?’’
—‘‘শোন, বাজে কথা বলিস না। আমি গিয়েছিলাম তুইও জানিস।’’
—‘‘চেষ্টা থাকলে উপায় হয়। তোর ইচ্ছাই নেই। যাই হোক, তুই থাক তোর লুকোনো জগৎ নিয়ে। আজীবন লুকিয়ে কাজ করে যা। সরাসরি করার তো ক্ষমতা নেই। সতীসাবিত্রী সাজতে হবে না তোকে।’’
—‘‘ঝগড়া করলে বল আমি মেট্রো ধরে চলে যাচ্ছি।’’
—‘‘ভীতুর ডিম। শোন, সতীত্ব না মারিয়ে ব্যক্তিত্বটা ঠিকঠাক কর। কে কী বলল তার পরোয়া না করে ব্যক্তিত্ব এমন রাখ যাতে কেউ কিছু বলতে গেলে একটু ভাবে।’’
—‘‘তোর জ্ঞান শেষ হলে বল কফিহাউজে গিয়ে বসি। জ্ঞানপাপী।’’
—‘‘না বন্ধু না, পিপাসু বলো।’’
সেদিন অদিতিদেবী ব্যাগ থেকে একটা মোটা লাল মলাটের বই বার করে দিয়েছিলেন অলোকার দিকে কফিহাউজের টেবিলে।
—‘‘প্রচুর টাকা বল তোর!’’
—‘‘এটা রাখ বাংলা অভিধান। খুব কাজে লাগবে দেখিস।’’
এই সব ভেবে অদিতিদেবী স্টেশনের সিমেন্ট বাঁধানো সিটে বসে একা-একাই হেসে ফেললেন।
অলোকা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে অদিতিদেবীর আত্মীয়। স্বামীর কড়া নির্দেশ ছিল। বাইরের নয় পরিবারের ভেতরে তো কত মানুষ আছে, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করো। সুতরাং আত্মীয় হলেও এমন একটা মুহূর্তে তিনি অলোকাকে পেয়েছিলেন যখন তাঁর একজন ভালো বন্ধুর খুব দরকার ছিল।
অলোকারও যে অদিতিকে দরকার ছিল না তা নয়।
তাঁদের দু’জনের মধ্যে ছিল এক গভীর শূন্যতাবোধ। খুব খারাপ সময় থেকে একে অপরকে বাঁচানোর চেষ্টা। যে শূন্যতায় তাঁরা নিজেদের ছদ্মবিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে এক নকল অস্তিত্বের রূপকে বড় করে তুলেছিলেন। এটা এঁদের কাছে বেঁচে থাকার থেকেও বেশি ছিল একপ্রকার টিকে থাকার সান্ত্বনা।
অদিতিদেবীর অবশ্য কারণ ছিল না তা নয়। সন্তানহীনতা, লাঞ্ছনা, অসুস্থতা— সব ছেড়ে আসার তীব্র যন্ত্রণা আর একটা অস্বাভাবিক শৈশব। যেসব যন্ত্রণার বিষ তিনি অনায়াসে নিশ্চিন্তে ঢেলে দিতে পারতেন অলোকার কাছে।
তবে অলোকা যথেষ্ট চাপা প্রকৃতির মানুষ। অদিতিদেবীও তাই কখনও কৌতূহল প্রকাশ করেননি। ভাঙার চেষ্টা করলেও কখনও জোর করেননি।
অদিতিদেবী বরাবরই লক্ষ করতেন এক আজানা অতৃপ্তিতে ভুক্তভোগী ক্লান্ত মানুষ অলোকা। আলোকার অতীত সম্পর্কে কখনও সে অদিতিকে কিছু বলেনি।
—‘‘আমার অনেক সহ্যশক্তি। তুই বল আমি শুনব।’’
—‘‘তুই নিজেরটা বলবি না। তাই না?’’
অলোকার ক্ষত হয়তো অনেকটা গভীর। ওর কাছে জানতে চাইলে হয়তো ভীষণ ভাবে ক্ষতবিক্ষত হবে। এসব ভেবেই অদিতিদেবী কখনও কৌতূহল প্রকাশ করেননি।
তাঁরা একে অপরের কাছে বর্তমানকে সুন্দর অতীতে গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। একটা সময়কে ঘিরে জন্মেছিল এই সম্পর্কের টান।
অদিতিদেবী বুঝতে পারতেন অলোকার একটি লুকানো জগৎ রয়েছে। যেখানে বরাবরই লুকোতে গিয়ে অলোকা ক্লান্ত হয়ে ওঠে। যা সে কাউকে বলতে চায় না। তবে না বলতে পারাটা তাকে ভীষণ ভাবে যন্ত্রণা দেয়। তিনি ভয় পেতেন এক সময় অলোকা এই কারণে বিপদে পড়তে পারে।
—‘‘গোটা জীবনটা চোখে ধুলো দিয়ে চলা যায় না অলোকা। নিজেকে ভাঙ। এক সময় মানুষকে থামতে হয় আর তখনই আসে পুরোনো আঘাতের মরচে ধরা যন্ত্রণা।’’
—‘‘আবার শুরু হল...’’
—‘‘অলোকা, একদিন ঠিক তোর মনে হবে মানুষের জীবন আমৃত্যু এক অজানা অসুস্থতা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রচেষ্টায় সে ছোটে। জীবনের শূন্যতাবোধ যখন মানুষকে আক্রমণ করে তখন যে কোনও কিছুকে আঁকড়ে ধরতে চায় মানুষ। কিছু কর। চাকরি নতুবা ক’টা টিউশন।’’
—‘‘দয়া করে ঘ্যানাস না।’’
অদিতিদেবী মৃদু হাসতেন। তাঁর এসব কথা অলোকার কাছে ছিল ঘ্যানানো। আসলে অলোকা নিজে সবটা জানত বলেই শুনতে চাইত না এসব।
অলোকার মধ্যে যে এক তীব্র খিদে দেখতে পেতেন অদিতিদেবী তাতেই ছিল তাঁর ভয়। সেটা নিয়ে অদিতিদেবীর মনে মনে অলোকার প্রতি মারাত্মক অভিমান ছিল।
যেটা অলোকার কাছে অবশ্য নিতান্তই মজার।
তখনও অদিতিদেবী লেখালেখি করতেন না।
—‘‘অলোকা, আমি বারবার বলছি নিজেকে যতক্ষণ প্রকাশ না করবি, যতক্ষণ তোর এই দেখানো জগতের অঙ্ক নিয়ে পথ চলবি, ততক্ষণ তুই বারবার তোর লুকোনো জগতের অন্ধকারে হারিয়ে যাবি আর এরকম অতৃপ্তিতে ভুগবি।’’
—‘‘তোর অসুবিধাটা কী বল তো? আমি তোকে কিছু বলিনি তাই তো!’’
—‘‘অলোকা, আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন করিনি কখনও। সুতরাং আমি বলা কওয়ার অপেক্ষায় থাকি না।’’
—‘‘তুই পেরেছিস অদিতি?’’
—‘‘আমি পারব। তুই দেখে নিস।’’
—‘‘দেখাস আগে।’’
শুরু হল অদিতিদেবীর লেখালিখি। কিন্তু...
অনেক বাধাবিপত্তি থাকলেও অদিতিদেবী নিজের গণ্ডি পার করলেন। অলোকা খুব খুশি হলেও একটা আপশোশ অদিতিদেবী বরাবরই তার মধ্যে দেখতে পেতেন।
—‘‘অলোকা, এভাবে না থেকে একটা চাকরি কর। তোর জন্য ওটাই সঠিক।’’
—‘‘এই বেশ আছি তো। খাচ্ছি, পড়ছি। চলছে তো। কী দরকার!’’
—‘‘ব্যঙ্গ না করে চেষ্টা কর।’’
—‘‘ওটা তুই কর। তাতেই খুশি আমি। আমার জগৎ খুব ছোট।’’
অদিতিদেবী জানতেন অলোকা যথেষ্ট আত্মমর্যাদাসচেতন মেয়ে ও স্বাধীনচেতা। ওর জগৎ কোনওভাবেই ছোট হতে পারে না।
—‘‘তোর আড়াল একদিন তোকে বিপদে ফেলবে। তুই আমাকেও হারাবি। সারাটা জীবন নিজেকে লুকোনো সহজ নয় অলোকা।’’
—‘‘তোকে আমি ছাড়ব না।’’
—‘‘ছাড়তে তোকে হবেই। ছেড়ে যাবে।’’
দূর থেকে হর্ন দিয়ে স্টেশনে ট্রেনটা ঢুকছে। অদিতিদেবীর ঘোর কাটল। ধীরে ধীরে সিট থেকে পা দুটো মাটিতে রাখলেন। তারপর চশমা খুলে চোখেমুখে হাত দিয়ে বুলিয়ে জলের বোতল থেকে জল চোখেমুখে ছিটিয়ে নিলেন।
ট্রেন ছাড়তে ঢের দেরি। স্টেশনে ধীরে ধীরে লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়েছে। চশমাটা মাথার ওপর নিয়ে অদিতি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে ফেলতে আবারও বসলেন। ম্যাগাজিনটা খুলে নামটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন অদিতিদেবী। চোখের কোণে ভেসে উঠল জল।
ঋজু তখন গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে সদ্য ভরতি হয়েছে যাদবপুরে। বাবাকে লুকিয়ে লেখালিখি। তাই ছদ্মনাম ব্যবহার। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও সাহিত্যের প্রতি তার ভীষণ টান। ওর বইয়ের টেবিলে প্রথম একটি উপন্যাসের বই দেখেছিলেন অদিতিদেবী। ‘নির্বাসন’। ডঃ অলোকা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বইটা পেছন ঘোরাতেই অলোকার ছবি। কলকাতার একটি নাম করা কলেজের বাংলার অধ্যাপিকা।
ঋজু ঘরে ঢুকতেই তড়িঘড়ি বইটা লুকোতে যাবেন। অমনি...
—‘‘মা লুকোনোর কিছু নেই। আমি বাবা নই। ওটা আমার প্রিয় লেখিকার বই।’’
—‘‘হুম’’
ছবিটা একমনে দেখছিলেন অদিতিদেবী।
—‘‘আচ্ছা মা, আর কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে লিখবে। ম্যাডামকে দেখো, বাংলা সাহিত্যের জন্য ভদ্রমহিলার সংগ্রাম সত্যি মুগ্ধ করে। জানো মা, ম্যাডামের সাথে খুব খুব দেখা করার ইচ্ছা। একদিন ওনার সাথে দেখা করবই। দুর্দান্ত ব্যক্তিত্ব। তুমি যে লুকিয়ে লুকিয়ে লেখো ওটা ওনাকে জানাব।’’
অদিতিদেবী একটু হাসলেন। চোখ ছলছল করছে তাঁর। ছবিটা দেখতে দেখতে বলেন, ‘‘কোথায় থাকেন তোর ম্যাডাম?’’
—‘‘বিদেশে। সম্ভবত এখন ইউএসএ। ডিভোর্সি। বাংলা সাহিত্য নিয়ে খুব লড়াই করছেন এখনও। খারাপ লাগছে বলো? তোমাদের কত কত মেয়েরা এখনও নিজের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। তোমরা তো নিজেরাই এক-একটা দীর্ঘ কবিতা।’’
অদিতিদেবী চুপচাপ ঘরের বাইরের বারান্দায় গিয়ে রেলিং-এর সামনে দাঁড়ালেন। হঠাৎ পিছু ফিরে শান্ত গলায় বললেন, ‘‘ঋজু ওনার আর লেখাগুলো...’’
—‘‘হ্যাঁ মা। আছে মোটামুটি সব বই-ই আছে। এর পরের বার মেসে গেলে এনে দেব। অসম্ভব ভালো লেখেন। নিজেকে নিঙড়ে লেখেন।’’
—‘‘মা, তুমি প্লিজ বাবাকে বোলো না আমি ছদ্মনামে লিখি। তবে তোমার মতো আমারও লেখা বন্ধ হয়ে যাবে।’’
—‘‘আমার লেখা তোর বাবার জন্য বন্ধ হয়নি ঋজু। তোর বাবার সাথে বিয়ের পরই আমার লেখালিখি শুরু। নিজেকে লুকিয়ে কোনও কাজ হয় রে! তুই তো লিখছিস, চুরি তো করছিস না। আমি ভেঙেও পুরোপুরি নতুন করে গড়তে পারিনি। তাই সামনের পথ আমার বন্ধ হয়েছে। যে সময়কে আমি মুছতে চেয়েছি তা আমার মধ্যে ঢুকে বসে আছে আজও।’’ একটু থামলেন অদিতিদেবী, ‘‘আমি নিজেই চাইনি লিখতে। নতুন করে আর কোনওভাবে ক্ষত হোক তা আমি চাইনি।’’
—‘‘কী যে বলো আর কোন লজিকে যে চলো, মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝি না।’’
—‘‘যেদিন বুঝবি সেদিন গল্প নয় কবিতা লিখবি।’’
—‘‘দিদি ট্রেন ছাড়তে পনেরো মিনিট বাকি। লাগেজ আমি তুলে দেব। দোকানে আছে। তোমার রিকশাওয়ালা আমার দোকানে এসে বসে আছে। দাদাবাবুকে বোধহয় ফোন করেছিল।’’
—‘‘হুম।’’
অদিতিদেবী উঠে দাঁড়ালেন। কাঁধে সাইডব্যাগ তুলে চশমাটা মাথা থেকে নামিয়ে মনে মনে বললেন, ‘‘আমি তোকে ক্ষমা করতে পারিনি আজও। আর তাই হয়তো ভুলতেও পারিনি তোকে। আজও মেনে নিতে পারি না তোর মিথ্যের জগৎটাকে। সেটাকে বাঁচাতে গিয়ে শেষমেশ তুই ঋজুকেও... যাই হোক, ঋজুকে তোর থেকে দূরে সরাতে চেয়েও আমি হেরেছি।’’
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে ম্যাগাজিনটা ব্যাগ ঢোকাতে ঢোকাতে বলেন, ‘‘সত্যি কি সব ছিঁড়ে, সবকিছু থেকে পালিয়ে নতুন রূপ নিয়ে নিজেকে ভাঙতে পেরেছিস অলোকা?’’
—‘‘দিভাই, কিছু বললে?’’
—‘‘না রে প্রণব। তুই লাগেজগুলো তবে এনে দে। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।’’
হঠাৎ কম্পার্টমেন্টের সামনে ভীষণ চিৎকার।
—‘‘কী হচ্ছে রে প্রণব?’’
—‘‘আর বোলো না। এখানে একটা পাগলি থাকে। পাগলি নয়, ট্রেনে কাটা পড়ে ওর পা দুটো বাদ গেছে। শ্বশুরবাড়ি নেয় না। বাপের বাড়িতে কেউ নেই। অগত্যা এখানেই ফেলে দিয়ে গিয়েছিল। তারপর ওই বাচ্চাটা হল।’’
—‘‘বাচ্চা হল? মানে আবার বিয়ে করেছে?’’
—‘‘আরে না গো দিদি। এদের আবার বিয়ে! পা নেই কেউ কিছু করলে কী করবে কাকে বলবে। বলেই বা কী হবে? ওর মেয়েটা চোর। তাছাড়া বাচ্চা মেয়েটাকে টাকা নিয়ে এর কাছে ওর কাছে পাঠায়। চুরি করে ধরা পড়লে চিৎকার করে, ‘বাচ্চার দিব্যি দিচ্ছি’, ‘বাচ্চার মাথায় হাত রেখে বলছি’, ‘আমার পা কাটা’। এসব বলে পিঠ বাঁচায়। যাদের মন নরম তারা ছেড়েও দিয়েছে কয়েকবার।’’
—‘‘বাচ্চার দিব্যি দিয়ে...’’
—‘‘এদের জীবনে কিছু আছে বলো তো দিভাই! এদের আবার দিব্যি! সবটাই তো মিথ্যার জগৎ। টিকে থাকার লড়াই। পেট ভরে খাওয়া আর টিকে থাকা।’’
অদিতিদেবী প্রণবের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে রইলেন। যে সহজ সত্যিটা প্রণব তাঁর ছাত্র হয়ে বুঝেছিল অদিতি এতদিনেও তা বোঝেননি।
এদের জীবনে কিছু আছে বলো তো...
মিথ্যার জগৎ নিয়ে টিকে থাকার লড়াই...
কথাগুলো তাঁর কানে বাজতে থাকল।
আজ কী হল অদিতিদেবীর? আজ এতদিন পর কেন অলোকাকে তাঁর মনে পড়ছে? কেন সে টানছে তাঁকে। সেই নিঃসঙ্গতা আবার কি তাঁকে ঘিরে ধরছে? আবার কি তাঁর অলোকার মতো কাউকে প্রয়োজন যাকে তিনি নির্দ্বিধায় সবটুকু রাগ-জেদ-কষ্ট ঢেলে দিতে পারবেন? যেখানে তাঁর অন্য কোনও রূপ নিতে হবে না। আজ অদিতিদেবীরও কি প্রয়োজন একটা নিজের জগৎ! হোক না হয় তা মিথ্যা। যেখানে তিনি নিজে সুখী। কাউকে খুশি করার প্রয়োজন নেই তাঁর।
অদিতিদেবীর আজ মনে হচ্ছে সত্যি তিনি অনেকদিন আগেই বৃদ্ধা হয়ে গেছেন। সেই সময় তাঁর ভেতর থেকে আজও সরেনি। তা তাঁকে আরও বয়স্ক করে তুলেছে। কাউকে তিনি দোষারোপ করতে পারেন না। কেউ তাঁর শরীরে কোনও অসুখ ঠুসে দেয়নি। বরং তিনি নিজেই নিজেকে প্রতিদিন তিলতিল করে মেরেছেন।
অদিতিদেবীর মেরুদণ্ড কুঁজো হয়ে গেল। তিনি কম্পার্টমেন্টের চারিদিকটা দেখে মনে মনে ভাবলেন কেন তিনি এত সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন একা খোঁড়াতে খোঁড়াতে? তাঁকে আজও তাড়া করছে সেই সময়। যা আধাখাপছাড়া করে তিনি নিজেই ছেড়ে এসেছিলেন।
অলোকের হাত ধরে তিনি অলোকাকে ফেলে দেননি তো এক অভিশপ্ত জীবনে? নিজেকে প্রশ্ন করে চলেছেন অদিতিদেবী। কেউ যেন তাঁর মাথাটাকে আরও নীচে নামিয়ে দিচ্ছে।
প্রণব মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
—‘‘শরীর খারাপ লাগছে দিভাই? জল দেব?’’
—‘‘নাহ। তুই যা।’’
—‘‘আচ্ছা তুমি তবে বোসো। আমি নিয়ে আসি। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। দোকান ছেলের কাছে ছেড়ে এসেছি।’’
প্রণব চলে যাচ্ছিল। অদিতিদেবী পিছু ডাকলেন, ‘‘প্রণব শোন, অলোকা কেমন আছে রে?’’
প্রণব একটু থেমে গেল। মুখোমুখি সিটে বসে বলল, ‘‘দিভাই আমি তোমাকে বলতেই যাচ্ছিলাম। তুমি এড়িয়ে গেলে তাই...’’ আবার একটু থেমে বলে, ‘‘অলোকাদি মারা গেছে। গত বছর পুজোয় বিদেশ থেকে এখানে এসেছিল মহালয়ার পরদিন। একদশীর বিকালে ব্যানার্জি বাড়িতে হঠাৎ হইহই। গেলাম সকলে। দেখলাম পুলিশ এসছে। অলোকাদির মৃতদেহ। পরে শুনলাম দিদি আত্মহত্যা করেছে ঘুমের বড়ি খেয়ে। কেন, কী হয়েছে, কিচ্ছু তদন্ত করে পাওয়া যায়নি।’’
অদিতিদেবীর চোখ থেকে জল বেরিয়ে এল। তিনি খালি হাতে সিট থেকে উঠে বাইরে চলে গেলেন।
—‘‘দিদি, বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে যেও না।’’
কম্পার্টমেন্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে পাগলির চিৎকার পেরিয়ে বাঁধানো সিমেন্টের সিটে গিয়ে বসলেন। যেখানে ভোরবেলায় কুলিটা উবু হয়ে শুয়েছিল।
পাগলি চিৎকার করছে, ‘‘ভালো হবে না, আমার মেয়ের ক্ষতি করা, ভালো হবে না।’’
অদিতিদেবী পায়ের সামনে দেখলেন সেই কাশফুলে রক্ত লেগে আছে। ভীষণ বমি পেল অদিতিদেবীর। গা-হাত-পা কাঁপতে শুরু করল। দম আটকে আসছে তাঁর।
প্রণব তাঁকে না ধরলে মাটিতে পড়ে যেতেন।
—‘‘দিদি, ও হরেনদা... তাড়াতাড়ি এসো’’ প্রণব চিৎকার করে উঠল, ‘‘বারবার কইলাম, একলা মাইয়া মানুষ... বাবু অখন কলকাতা থেকে ফোন করলে কী কমু!’’
টিকিট কাউন্টারের ছেলেটা কাউন্টার থেকে বেরিয়েছিল কোনও কারণে।
—‘‘আরে প্রণবকাকা, কী হলো গো? এ তো জেঠিমা। আমি বললাম এখানে বসুন। চলো চলো এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে। আমি কলকাতায় ঋজুকে ফোন লাগাচ্ছি।’’
তোমার গদ্য আগে কখনো পড়িই নি দি... সেখানেও তুমি স্বয়ংসিদ্ধা ❤
ReplyDeleteঅনেক ভালোবাসা 😊
Delete