খাঁচা
তখন আমি খুব ছোটো। ইস্কুলে ভর্তি হইনি। চৌধুরীপাড়ায় মল্লিকদের বাগানবাড়িতে ভাড়া থাকতাম। অবিশ্যি ভাড়াটে ব্যাপারটাই তখন বুঝতাম না। সে যাই হোক। ওই বাড়িতে তিনটে ঘর ছিল। একটা টালির। বাড়ির ছাদে ওঠার কোনো সিঁড়ি ছিল না। কিন্তু আমার ছাদে উঠতে খুব ইচ্ছে করত। কারণ ঘরের ঘুলঘুলিতে শালিকপাখি বাসা করেছে! বাসায় দুটো-তিনটে ছানা! দাদা বলেছিল।
একদিন একটা ছানা আমাদের ঘরে পড়ল! খুব ছোটো। পালক গজায়নি। আমি ধরে জুতোর বাক্সে রাখলাম। ড্রপারে করে ছাতু-গোলা খাওয়াতাম।
একদিন স্নানযাত্রার মেলা থেকে দাদা একটা কাঠের খাঁচা এনে দিল! শালিকছানাটা তাতে থাকত। কয়েকদিনের মধ্যে গায়ে পালক গজাল। খেতেও শিখল নিজে থেকে।
একদিন দেখি: খাঁচার ওপরে মা-শালিকটা এসে বসেছে!
আমার মা বলল: ছেড়ে দে— উড়ে চলে যাবে!
—কেন? অত কষ্ট করে বড় করলাম!
—তাতে কী! তোকে যদি কেউ ধরে নিয়ে যায়— তাহলে আমার কষ্ট হবে না?
আমি চুপ।
মা বলল: পোষ মেনে গেছে— ছেড়ে দিলেও দেখবি উড়ে উড়ে আসছে— মনে কর না আমাদের বাড়িটা একটা মস্ত বড় খাঁচা— এখানে হাঁস-মুরগি-মানুষ-পাখি সবাই থাকে!
মা-এর কথায় আমি শালিকছানাটা ছেড়ে দিলাম। তবে সত্যি সত্যি সে আসত। আমি ছাতুমাখা দিতাম। খেয়ে চলে যেত।
তারপর একদিন আমাদের সেই বাড়ি ছাড়তে হল। আমরা পুবপাড়ায় ভাড়া উঠে এলাম। তবে হাঁস-মুরগি বিক্রি করে দিতে হল। নতুন বাড়িতে হাঁস-মুরগি পোষা নিষেধ!
ছোটো কাঠের খাঁচাটা এনেছি। বড়ো খাঁচাটা রয়ে গেল!
চাঁদ
আকাশে আধখানা চাঁদ দেখে গীতা দত্তের সেই গানটা মনে পড়ে গেল: নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে/ চুপি চুপি বাঁশি বাজে বাতাসে বাতাসে...
কিন্তু এখন বাঁশি বাজছে না। দেদার কুকুর ডাকছে! রাত কত কে জানে! আমি এখন ছাদে। বউ ডিউটিতে। নিজে থেকে দাঁড়াতে পারি না। আরতি ধরে ধরে দাঁড় করায়! দু’ বছর আগে একটা অ্যাক্সিডেন্টের পর পা দুটো অকেজো। প্রাইভেট ফার্মের চাকরিটাও চলে গেল। বউ একটা চাকরিতে ঢুকেছে। কী কাজ আমি ঠিক জানি না। তবে সংসার চলে আরতির রোজগারে। সে যাই হোক।
আজ সন্ধেবেলা বউকে ধরে ধরে ছাদে উঠেছি। ও তালা দিয়ে চলে গেল— আমি যদি একা-একা নামতে যাই: এই ভয়ে!
আগে আমি কবিতা লিখতাম। অনেক ছাপাও হয়েছে। কিন্তু বছরখানেক একটাও লিখতে পারছি না! আজ একটা লিখব। কিন্তু সেই থেকে একটা লাইনও মনে আসছে না। কবিতার প্রথম লাইনটাই আসল। চাঁদ নিয়ে কত ভালো ভালো কবিতা আছে। সুকান্ত থেকে সুবোধ সরকার পর্যন্ত। কে যেন লিখেছিল: দুঃখী মানুষের জীবনে চাঁদ থেকেও নেই! এই জাতীয় একটা বাক্য ভাবছি এমন সময় আরতি। ধপাস করে বসে পড়ল আমার পাশে। ওর গায়ে কেমন বিশ্রী গন্ধ! বললাম: আরু তোমার গায়ে কীসের গন্ধ?
—সেন্টের।
বলেই ও দাঁড়াল!
—আমার হাতটা একটু ধরো তো— দাঁড়াব!
কিন্তু ওর শরীর টালমাটাল— নিজেই পড়ে যাচ্ছিল!
—কী হল শরীর খারাপ নাকি?
আরতি অন্য কথা বলল: চাঁদটা কী সুন্দর লাগছে দ্যাখো!
আমি চুপ! কবিতার ক’টা লাইন মাথার ভিতর ঢুকে গেল:
আকাশের চাঁদ দেখিয়ে শিশুকে ভোলায় স্নেহময়ী মা!
আর যার জীবনে কোনো চাঁদ নেই
সেই হতভাগা চাঁদ দেখে অনেক কিছু ভুলতে চায়!
আনারস
আমার মেয়ে কোনোদিন আনারস খায়নি। আজ খাবে। বাজারের পয়সা বাঁচিয়ে কিনেছি। কুড়ি টাকা নিলে! তা নিক। একবারই তো! একরত্তি মেয়েটা খেতে চেয়েছে— ওকে কী-ই বা দিতে পারি!
বাড়িতে আসতেই বউ বলল: আটা এনেছো?
—হ্যাঁ!
—এত কম কেন? তোমাকে তো এক কিলোর দাম দিলুম!
আমি চুপ!
বউ ফের বলল: পিঁয়াজ মাত্র তিনটে?
—অনেক দাম যে!
—এই একশো টাকার বাজার?
—জিনিসপত্তের মেলা দাম—
—উচ্ছে কয়?
—নিমপাতা এনেছি তো!
—ও তো গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা!
আমি আর কী বলব! বাজারের পয়সা বাঁচিয়ে আনারস কিনেছি— সেটা তো আর বলা যায় না!
বাগানে-বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল মেয়েটা! দৌড়ে এসে বলল: বাবা আনারস?
—এনেছি।
—কোথায়?
—ওই তো বালতির জলে।
শুনতে পেয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে বউ: তোমাকে আনারস আনতে কে বললে?
—ওই মেয়েটা বায়না ধরলে—
—তাই তো বলি সব জিনিস কম কম কেন!
আমি আস্তে করে বলি: একদিন তো!
বউ হুংকার দিল: একটা পয়সা তো রোজগারের মুরোদ নেই—
আমি সামনে থেকে সরে যাই। কথাটা ঠিক। কুণ্ডু মিলের কাজটা চলে যেতে কাঠ বেকার! আলেকালে লোকের বেড়া বাঁধি। বাগান সাফ করি! বউ মুড়ি ভাজে! দু’ বাড়ি রান্না করে।
বেলা তিনটে হবে!
বউ একটু ঠান্ডা! সে এখন আনারস ছাড়াতে বসেছে। সামনে মেয়েটা। আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। বাবা আনারস আনলে মা ছাড়াতে বসত। আর আমরা ছ’ ভাই-বোন গোল হয়ে বসে থাকতাম। ও: কী অম্ল-মধু স্বাদ! এখনও মুখে লেগে রয়েছে!
এক টুকরো ফল গালে ফেলে মেয়েটা বললে: বাবা আনারস এইরকম খেতে?
—কেন খারাপ?
—হ্যাঁ!
আমি এক টুকরো আনারস মুখে ফেললাম। রস নেই। বিস্বাদ।
বউ বললে: নগদ পয়সায় ফেলামাল এনে দরদ দেখাচ্ছে!
আমি চুপ!
মেয়েটা বললে: আমি আর খাব না!
বউ বললে: ছাগলকে দিয়ে দে!
আমি আর কী বলি! সত্যি তো— ভালো না লাগলে খাবে কী করে!
গজগজ করতে করতে বউ পুকুরঘাটে চলে গেল। আমি বেরিয়ে পড়লুম একটা বিড়ির ধান্দায়। কী করব! বিড়ি কেনার পাঁচটা টাকাও আনারসের মধ্যে ঢুকে গেছে! আর মনের সুখে সেই ফল চিবোচ্ছে ছাগলটা!
No comments:
Post a Comment