মাছরহস্য
গঙ্গার ধারে চুপ করে একা বসেছিল মণীষ। সময় পেলেই এভাবে এসে বসে থাকে। সন্ধে নামছে। জমাট হচ্ছে অন্ধকার। দূরের ব্রিজে লাল, সবুজ, হলুদ আলো জ্বলছে, নিভছে।
সন্ধে হলেই একজন জেলে কপালে টর্চ, কোমরে হাঁড়ি বেঁধে, হাতে তেকোণা জাল নিয়ে চিংড়ি ধরতে বেরোয়।
সেদিন ছিল পূর্ণিমা। গঙ্গার জলে চাঁদ হাসছিল, খেলছিল। মানুষকে পূর্ণ করে তুলছিল।
সেদিনও গঙ্গার ধারেই বসেছিল মণীষ ও সে। জেলেটা গঙ্গায় চিংড়ি ধরতে নেমেছিল। হঠাৎ আনন্দের আওয়াজ এসেছিল, পেয়েছি!
পাড় থেকেই মণীষ বলে উঠেছিল, কী হল?
—বেশ বড় একটা মাছ, উত্তর এসেছিল। তারপরেই আওয়াজ, যাঃ!
আর্তনাদ করে উঠেছিল মণীষ, এবার কী হল!
—পালিয়ে গেল।
তারপর থেকে মণীষ মাঝেমধ্যেই এখানে বসে। লক্ষ রাখে, জিজ্ঞাসা করে মাছটা ধরা পড়ল কিনা।
আজ অমাবস্যা। একইভাবে সেই পুরনো চিৎকার জেলের, পেয়েছি!
উঠে দাঁড়িয়ে মণীষও চিৎকার করে, পেয়েছ? পেয়েছ মাছটাকে?
আজও জেলে বলে উঠল, যাঃ!
—কী হল!
—ধ্যাত! একটা সাপ। ফেলে দিলাম।
—ও।
ফিরে গেল মণীষ। আবারও ফিরে আসতে হবে। কিছুদিন পর। জানার চেষ্টা করতে হবে, মাছটাকে পাওয়া গেল কিনা...
মাংসের ক্যানভাস
ক প্রস্তাব করতেই খ-এর মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। খ বলল, তোরা এতদিনের বন্ধু! তোরা জানিস না, আমি থাই নয়, আমি ব্রেস্টের মাংস পছন্দ করি? গ কেন ব্রেস্টের মাংস নেবে! আর তাছাড়া ও তো মুরগিটাকে দেখেই বলেছিল, ও থাই নিতে চায়।
ক শান্ত করল খ-কে। বলল, ঠিক আছে। অশান্তির কিছু নেই। যার যেটা পছন্দ, এবং প্রথমে যে যেটা বলেছিল, সেখানকার মাংসই নেবে।
ঘ এতক্ষণ চুপ করেছিল। অথচ ওজনদার বনমুরগিটাকে ধরতে, বাঁধতে আর জবাই করতে ওর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। ঘ হঠাৎ বলল, শালা, ক না খেটে লেগ আর থাই-এর মাংস পেয়ে গেল। গ কনভিন্স করে ব্রেস্টের মাংস। তাহলে শালা আমি কি আঙুল চুষতে এত পরিশ্রম করেছি! আমি আগে মাংস নেবার পর বাকিরা যেন নেয়।
বুঝতে পারছিলাম ক প্রচণ্ড বিভ্রান্ত। কাকে মাংসের ঠিক কী বখরা বা ভাগবাটোয়ারা দেবে, বুঝতে পারছে না।
বাধ্য হয়ে আমি, মানে, লেখককে ঢুকতে হয় রঙ্গমঞ্চে। আমি ক, খ, গ ও ঘ-কে রীতিমতো সাবধান করে বলি, সম্মান করতে শেখো। একটা জলজ্যান্ত, সুন্দর মধ্যকুড়ির মেয়ে। আর তোমরা তাকে মুরগি বলছ! ছিঃ!
ক, খ, গ ও ঘ মাথা নীচু করে। আমি তখন হাত থেকে পেন নামিয়ে চপার তুলে, মেয়েটার দুটো ব্রেস্টের একটা গ ও আর-একটা খ-কে কেটে দিলাম।
তারপর দুটো লেগ আর থাই মেয়েটার দেহ থেকে সমান করে কেটে ক ও ঘ-কে দিয়ে দিই। তারপর পেন হাতে তুলে চুপ করে বসে ওদের চারজনের কাণ্ডকীর্তি দেখতে থাকি। আমার শুধু একটা ঠিকঠাক লেখার ক্যানভাস দরকার। ব্যস! তাহলেই শব্দশিল্প ফুটিয়ে তুলতে পারব।
লেখার ছক কাটছি ডায়েরিতে, হঠাৎ দেখি, প্রবল হইহট্টগোল। দেখলাম, ক, খ, গ, ঘ মাংসের টুকরোগুলো নিয়ে পাগলামি করছে। নগ্নদেহে মাংসের টুকরোগুলো বোলাচ্ছে, নিয়ে লাফালাফি করছে। আমি চেঁচিয়ে বললাম, নিজেদের মাংসের টুকরোগুলো অন্যদের দিয়ে দাও। আর অন্যদেরগুলো নিজেরা নাও।
কাজ হল। বিনিময়ের পর ওরা কিছুটা শান্ত হল।
পেন তুলে লিখতে যাব, শুনলাম, আবার গণ্ডগোল। ওরা কেউই মাংসের টুকরোগুলো নিয়ে আর খেলতে চাইছে না। চোখের সামনে দেখলাম, একে অপরের মাংসের টুকরোর দখল নিতে গিয়ে নিজেদের মেরে ফেলছে। খুন করছে।
মাথা গরম হচ্ছিল। আমার সৃষ্টির ক্যানভ্যাস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কী করব, ভাবছি। এবার দেখি, মাংসের টুকরোগুলো একজায়গায় জড়ো হচ্ছে। পেশিবহুল হচ্ছে। এবং অদ্ভুতভাবে, তা ক, খ, গ, ঘ-এর দিকে ছুটে এল না। বরং তেড়ে আসছে আমার দিকে। পেন নামিয়ে, কোথায় ছুটে পালাব, আমি এখন তাই ভাবছি...
শিল্পী
দুর্গাপুজো। থিম আর ট্র্যাডিশনের ঠোকাঠুকি। থিম এগিয়ে।
বড়বাগান। ভিড় উপচে পড়ছে। এবারের থিম ভিয়েতনাম থেকে তুলে আনা। ইন্দোচিনের ইমপোর্টেড সবুজায়ন। বাঁশে আর্ট ব্যস্ত দিশি লেবার। ঘরানা প্রাচ্য বিদেশি। প্রতীকবরণ ঘোষ। মণ্ডপ শিল্পী। খাদির হাঁটু পর্যন্ত পাঞ্জাবি। গালে চাপ লম্বা দাড়ি। এদিক-সেদিক ছোটাছুটি। প্যান্ডেলে কাজ করা সুপারভাইজার বা লেবারদের ধমক কখনও-সখনও, আরে বোকা, মাচার মাথাটা বেআবরু হয়ে বেরিয়ে পড়েছে।
ফিসফাস— বড় শিল্পী!
প্রেস কনফারেন্সে প্রতীকবরণ। বুকভরা শ্বাস। বললেন, নীরবে বলবে শিল্প। প্যান্ডেলের কনসেপ্টটা পেতে লাস্ট ইয়ার সবার চোখের আড়ালে ভিয়েতনামের একটা জঙ্গুলে গ্রামে পাঁক আর জোঁকের মধ্যে তিনদিন থেকেছিলাম। এখানে একটা ক্যানভাস পেতেই ফুটিয়ে তুললাম।
পটাপট ছবি। নোটপ্যাডে রিপোর্টারদের দ্রুত হাত।
দূরেই তখন প্রাচ্য বাঁশের উপর একমনে নকশার আদল কেটে কেটে বসাচ্ছিল এক ফুরনের লেবার। হাতে আর একদিন...
No comments:
Post a Comment