বাক্‌ ১৪৫ ।। একটি স্বাভাবিক মৃত্যু ।। রাহুল দাশগুপ্ত

 


প্রথম পরিচ্ছেদ : রবিবার

Man does not learn unless he is thrashed.

Menander

 

 

এটা একটা ভেজাল কোম্পানি। নাম, "ডেথ মাস্ক"। এখানে আমরা পুঁথি ভেজাল করি। সেই লম্বা লোকটি বলে ওদের দিকে তাকিয়ে।

পাশাপাশি দু-টি চেয়ারে বসে আছে চেরাব আর সেই মেয়েটি। মেয়েটির নাম, দময়ন্তী। দু-জনেই লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে। লোকটি খুব স্মার্ট। লম্বা, কালো, কোঁকড়ানো চুল। কিন্তু কথা বলার ধরনটি কেমন যেন অমার্জিত। যদিও লোকটির সেটা ইচ্ছাকৃত নয়। কথা বলার সময় আপনিই এটা ঘটে। কিন্তু লোকটি এ ব্যাপারে সচেতন নয। লোকটির নাম, অগ্নিমিত্র।

চেরাব ঘরের চারদিকে তাকায়। এটাও একটা কাঁচের ঘর। শুধু ঢোকার অংশটুকু বাদে বাকি অংশে রয়েছে প্রায় আযতকার টানা ডেস্ক। তার ওপর পর পর কযেকটি কম্পিউটার রাখা।

অগ্নিমিত্র বলে, তোমাদের দু-জনের সামনেই দু-টি করে পুঁথি রাখা হয়েছে। সাতদিন সময়। প্রতিদিন তোমাদের একটি করে পুঁথি দেওয়া হবে। নতুন করে লিখতে হবে এই পুঁথিগুলিকে। মানে, ভেজাল করতে হবে। এটাই তোমাদের কাজ। কীভাবে ভেজাল করবে, তার একটা নির্দেশিকা পুঁথির পাশেই রাখা আছে। ওটাই ফলো করবে। কোনওদিন যদি পুঁথি না দেওয়া হয়, তবে পুঁথি সংক্রান্ত কোনও কাজই দেওয়া হবে।

"ভেজাল" শব্দটা কানে এসে ধাক্কা মারে চেরাবের। সে জানতে চায়, ভেজাল করতে হবে?

"ভেজাল" এই দেশে খুবই পবিত্র শব্দ। তোমার বোধহয় জানা নেই। অগ্নিমিত্রের মুখটা কঠোর দেখায়। তারপর সে বলে, তোমরা মোটা বেতন পাবে। আর চুপচাপ নিজেদের কাজ করে যাবে। এখানে প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ। শুধু জেনে রাখো, রাষ্ট্রই আমাদের কোম্পানিকে এই দায়িত্ব দিয়েছে। খুব কঠিন দায়িত্ব। সরকারি ইতিহাস লেখা কোনও সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে, নতুন করে লেখা। আগের ভুলভ্রান্তিগুলোকে শুধরে লিখতে হবে।

এবার দমযন্তী বলে, পুঁথিগুলোতে ভুল তথ্য আছে?

ভুল না ঠিক, তা একমাত্র রাষ্ট্রই ঠিক করতে পারে। ওসব আমাদের দেখার কথা নয়। ও নিয়ে তোমরা মাথাই ঘামাবে না। আমরা শুধু দেখব, রাষ্ট্র কী চায়! সরকারি নির্দেশিকা তোমাদের দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী তোমরা শুধু লিখে যাবে। আমরা সেই ইতিহাসই লিখব, যে ইতিহাসকে রাষ্ট্র চায়। নিজের সুবিধার জন্য এবং দেশের মানুষকে শেখানোর জন্য।

এবার চেরাব বলে, কিন্তু সে ইতিহাস তো ভেজাল ইতিহাস হবে।

অগ্নিমিত্র কঠোর গলায় বলে, হলেই বা! "ডেথ মাস্ক" একটি ভেজাল কোম্পানি। রাষ্ট্রের সবচেয়ে পছন্দের কয়েকটি প্রাইভেট কোম্পানির একটা। রাষ্ট্র আমাদের চোখ বুজে বিশ্বাস করে। আমরা সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রেখে চলি। গোটা বিশ্বে আমাদের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে আছে। আমাদের একটা সম্মান আছে। আমরা ভেজাল করি সম্মানের সঙ্গে। ভেজাল করাটা একটা সম্মানজনক ব্যাপার।

চেরাবের মাথা ঘুরছিল। দময়ন্তী আড়চোখে তাকে দেখল। তারপর বলল, আমরা কী এখনই কাজ শুরু করব?

আগে তোমরা কিছু খেয়ে নাও। অগ্নিমিত্র বলল। অনেক সকালে বেরিয়েছ তোমরা। আমি তোমাদের ক্যান্টিনে নিয়ে যাচ্ছি...

দময়ন্তী অগ্নিমিত্রের দিকে তাকাল। তার চোখে চোখ রাখল। কেমন একটা মুগ্ধতার রেশ সেখানে। চেরাব একটু অস্বস্তিই বোধ করল।

ক্যান্টিনে পৌঁছে দময়ন্তী বলল, আমি এই পথ চিনে ফিরে যেতে পারব না।

চেরাবের মনে পড়ল, অনেক উঁচু-নিচু সিঁড়ি আর অন্ধকার করিডোর পেরিয়ে এখানে এসেছে তারা। এই পথ চিনে ফিরে যাওয়া সত্যিই কঠিন।

দময়ন্তী আবার বলল, তুমি পারবে?

পারব। কফির কাপে প্রথম চুমুকটি দিয়ে ছোট্ট উত্তর দিল চেরাব। তার চোখ দময়ন্তীর দিকে। সে চোখে মুগ্ধতার রেশ।

 

স্যান্ডউইচে একটা কামড় বসিয়ে দময়ন্তী বলল, একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছ?

চেরাব মুচকি হাসল। তারপর বলল, চেয়ার!

ঠিক তাই।

ক্যান্টিনে বসে ওদের কথা হচ্ছিল। ঘরটি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ছোটো ছোটো কাঁচের টেবিল। সেই টেবিলকে ঘিরে দু-তিনজন বসতে পারে। একদিকে একটা টানা কাঁচের জানলা। সেই জানলার সামনে দাঁড়ালে শহরের একটি ব্যস্ত রাস্তাটাকে দেখা যায়। চেরাব একবার উঠে দেখে এল। আর তখনই সে চমকে উঠল। সেই কালো ঘোড়া। বারবার কেন দেখা হয়ে যাচ্ছে ওই ঘোড়াটার সঙ্গে।

দময়ন্তী বলল, আমি সত্যিই আশ্চর্য হয়ে গেছিলাম। লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না, অথচ চেয়ারটাকে দেখা যাচ্ছে। কাঁচের ঘর। স্বচ্ছ কাঁচ। কিন্তু বস কোথায়? শুধু চেয়ারটা, ওর কুচকুচে কালো রং, যেন নিষ্পলক চোখে গোটা অফিসটার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখলে শিউড়ে উঠতে হয়...

বস কী সত্যিই ছিলেন? চেরাব জানতে চাইল।

নিশ্চয়ই। দময়ন্তী জোর দিয়ে বলল। অগ্নিমিত্র কী বলল মনে নেই? বস ওই ঘর ছেড়ে কোথাও যান না. তিনি ঘরের ভেতরেই সবসময় থাকেন। কিছুদিন আগেই তাঁর হার্টে একটা বড় গোলমাল ধরা পড়েছে। অপারেশন করতে হবে। তারপর থেকেই তো তিনি...

উনি নিশ্চয়ই ঘরে ছিলেন নাপাশেই ওর একটা সিক্রেট চেম্বার রয়েছে। সেখানে উনি বিশ্রাম নেন। অথবা টয়লেটে যেতে পারেন। চেম্বারের সঙ্গেই রয়েছে সেটা। অগ্নিমিত্র তো এরকমই বলছিল।

দময়ন্তী কফিতে চুমুক দিয়ে বলে, নিশ্চিত করে আসলে কিছুই বলা যায় না। উনি ঘরে থাকলেও বাইরে থেকে দেখা যায় না। শুধু চেয়ারটাকেই দেখা যায়। আমি যখন ইন্টারভিউ দিতে গেছিলাম, তখনই দেখেছি।

আমিও দেখেছি। চেরাব একমত হয়। ব্যাপারটা ওকেও ভাবিয়েছিল।

ঠিক এই সময় দু-টি ছেলে এসে ওদের সামনে দাঁড়ায়। দু-জনেই বেশ লম্বা। একজন ফর্সা, অন্যজন কালো। দু-জনেরই হালকা গোঁফ আছে। ফর্সা ছেলেটির মাথার চুল তুলনায় ঘন। কালো ছেলেটির পাতলা। ফর্সা ছেলেটিই প্রথম কথা বলে। চেরাবের দিকে তাকিয়ে সে নিজেদের পরিচয় দেয়, আমার নাম নির্ঝর। আর এ হল, মোক্ষ। অগ্নিমিত্রের কাছে তোমাদের কথা শুনলাম। আমরা তোমাদের কলিগ। এখানে, তোমাদের সঙ্গে, একটু বসতে পারি?

দময়ন্তী তুলনায় বেশি সপ্রতিভ। সে-ই আগে বলে ওঠে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। তোমাদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ায় খুবই ভাল লাগছে।

একটু পরেই ওদের আলাপ জমে উঠল। বিশেষ করে নির্ঝর আর দময়ন্তীর। মোক্ষ একটু চুপচাপ। সে মন দিয়ে বাকিদের কথাবার্তা শুনছিল। মাঝেমধ্যে দু-একটা কথা বলছিল। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলতে পারে সে। চেরাব মোক্ষের প্রতিই বেশি আকৃষ্ট হচ্ছিল। নির্ঝর অনেক কথা বলে। কিন্তু তার বেশিরভাগ অর্থহীন। মোক্ষ কথা বলে কম। কিন্তু সেগুলি জরুরি।

নির্ঝরের গলার স্বর বেশ গম্ভীর। যখন কথা বলে, শুনতে ভাল লাগে। সে বলে, তোমরা ঠিকই দেখেছ। ওই কাঁচটা ওরকমই। বাইরে থেকে শুধু চেয়ারটাই দেখা যায়। বসকে দেখা যায় না।

চেরাব জানতে চায়, কিন্তু কেন? এটা কীভাবে সম্ভব?

মোক্ষের মুখটা হঠাৎ পাল্টে যায়। গম্ভীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু স্বাভাবিক হাসি নয়। তীব্র শ্লেষের হাসি। তার গলার স্বরে যেন চাবুক ঝলকে ওঠে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়?

দময়ন্তী চমকে উঠে বলে, স্বাভাবিক? এটাই স্বাভাবিক?

মোক্ষ বলে, ঠিক তাই। এটাই স্বাভাবিক। চেয়ারটাই তো যথেষ্ট। গোটা অফিস ওই চেয়ারটার ভয়ে কাঁপছে। তারা শুধু ওই চেয়ারটাকেই দেখে। অন্য কিছু তাদের চোখেই পড়ে না। বস এটা জানেন। তিনি শুধু শুধু লোকের চোখে পড়তে যাবেন কেন? বসেরা বেশি জনসমক্ষে আসতে চান না। তাঁরা যত নেপথ্যে থাকেন, তত তাঁদের নিয়ে রহস্য জমে ওঠে। এটাই তো নিয়ম।

নির্ঝরের কথা শুনে বোঝা যায়, সে খুব অগ্নিমিত্রের ভক্ত। কথায় কথায় সে অগ্নিমিত্রের প্রসঙ্গ টেনে আনে। এবার সে বলে, অগ্নিমিত্র বসের খুব কাছের লোক। ওই ঘরে যখন-তখন ঢুকতে পারে। বসের কাছে যেতে পারে। বসের সঙ্গে কথা বলতে পারে। এই অফিশের একজন পরিচালক ও। বস ওকে খুব স্নেহ করেন। উনি নিঃসন্তান। বস ওকে নিজের ছেলের মতোই ভালবাসেন। ওই চেয়ারটা নিয়ে ওর মধ্যে কোনও ইলিউশন নেই। ও ম্যানেজমেন্টের অংশ। চেয়ারটাকে চাক্ষুষ দেখে। আমরা দেখি দূর থেকে। কাচের আড়াল থেকে। তাই আমরা এত জল্পনা-কল্পনা করি...

নির্ঝর যতক্ষণ কথা বলে, মোক্ষ কাঁচের জানলা দিয়ে উদাসীনভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। নির্ঝরের উৎসাহ ও উত্তেজনার পাশে ওর এই ঔদাসিন্যকে আরও বেশি করে চোখে লাগে।

চেরাব বলে ওঠে, আসলে কাছে-দূরের প্রভেদ একটা থাকেই। কোনও জিনিসকে কাছ থেকে দেখলে একরকম লাগে, দূর থেকে দেখলে অন্যরকম।

হঠাৎ মোক্ষ বলে ওঠে, মকবুল একবার ডেকেছিল। যাই, গিয়ে দেখে আসি একবার...

এবার নির্ঝরের মুখটা কেমন যেন কঠোর দেখায়। সামান্য পরে ওরা দুজনেই উঠে যায়।

 

ফেরার সময় বেশ অসুবিধা হয় ওদের। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে একটা ঘোরানো সিঁড়ির সামনে এসে পৌঁছয় ওরা। এবার নিচে নামতে হবে।

দময়ন্তী বলে, আমার সন্দেহ হচ্ছে। যে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে আমরা উঠে এসেছিলাম, তার রেলিংয়ের রং ছিল সবুজ। কিন্তু এটার তো দেখছি লাল...

চেরাব বলে, আমরা বেশ কয়েকবার ঘোরানো সিঁড়ি পেয়েছি। শেষ যেবার পেয়েছি, তখন রেলিংয়ের রং লালই ছিল।

দময়ন্তী আর কোনও প্রশ্ন করে না। চেরাবের দিকে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। তারপর মাখো মাখো গলায় বলে, তুমি ঠিকই বলেছ! কেন যে আমি এত ভুল করি!

চেরাব একটু অবাক হয়। দময়ন্তী ওর ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছে। সেই নির্ভরতায় কোনও চাপ নেই। বরং কেমন একটা আবছা ভাল লাগা তৈরি হচ্ছে ওর মনে। একটি মেয়ে, অত্যন্ত সুন্দরী আর প্রাণোচ্ছ্বল, ওর ওপর নির্ভর করছে। ওর অস্তিত্বের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব। এরকম আগে কখনও হয়নি ওর জীবনে। ঘোরা্নো সিঁড়ি দিয়ে ওরা নেমে আসে। এবার সামনে একটা সরু করিডোর। সেই করিডোর ধরে ওরা এগোতে থাকে। সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে। করিডোরে হালকা, মৃদু, হলুদ আলো। সেই আলোয় দময়ন্তী মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে চেরাবের দিকে। তার মুখ হাসিতে ঝলমল করছে। যেন দু-জনে মিলে একটা অ্যাডভেঞ্চারের ভেতর ঢুকে গেছে। দময়ন্তী যখন তাকাচ্ছে, চেরাবের বুকের মধ্যে যেন একটা শিহরন খেলে যাচ্ছে। নিজের ভেতরে সে একটা জেদ টের পাচ্ছে। কিছুতেই পথ হারালে চলবে না। রাস্তা চিনে দময়ন্তীকে পৌঁছে দিতে হবে। দময়ন্তী ওকে বিশ্বাস করেছে। ওর ওপর নির্ভর করেছে। এই ব্যাপারটা খুবই উপভোগ করছে চেরাব। আবার সেই বেহালার সুরটা বাজছে। চেরাব শুনতে পাচ্ছে সেই সুর। কোত্থেকে আসছে এই সুর? কে বাজাচ্ছে?

সে জানতে চায়, এখানে কে বেহালা বাজাচ্ছে বলো তো?

বেহালা? কই, আমি তো কিছু শুনতে পাচ্ছি না! দময়ন্তী অবাক হয়ে বলে। তোমার মাঝেমাঝেই কী হয় বলো তো? আগেও একবার...

সত্যি? তাহলে আমি পাচ্ছি কেন? চেরাব ঠিক বুঝতে পারে না। দময়ন্তী এক ঝলকের জন্য ওর দিকে তাকিয়েছিল। সুরটা খুব তীব্র হয়ে উঠেছিল তখন। তবু দময়ন্তী শুনতে পায়নি। কেন হয় এরকম? চেরাব আবার সামনের দিকে তাকায়।

করিডরটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে নেমে গেছে একটা ঘোড়ানো সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে ওরা নেমে এল। আবার একটা সরু করিডর। আবার সেই মায়াবি অন্ধকার। হালকা আলো। করিডরের গা দিয়ে পরপর বেশ কয়েকটি সিঁড়ি উঠে বা নেমে গেছে। এগুলি সবই ঘোরানো সিঁড়ি।

চেরাব জানতে চায়, আমরা কোন সিঁড়িটা ধরব বলো তো?

দময়ন্তী চেরাবের দিকে তাকায়। হাসে। বেহালার সুরটা তীব্র হয়ে ওঠে হঠাৎ। দময়ন্তী বলে, জানি না।

তাহলে কে জানে?

তুমি।

খুব নিশ্চিত করে দেখায় দময়ন্তীকে। আবার একটা ঘোরানো সিঁড়ি। ওরা নেমে আসে। আবার সরু করিডর। উল্টোদিক থেকে একটি লোক এগিয়ে আসছে। দময়ন্তীর ফর্সা মুখে হঠাৎ একটা লালচে আভা দেখা দেয়। সে বলে ওঠে, অগ্নিমিত্র নাকি?

কিন্তু এই লোকটিকে ওরা চেনে না। দময়ন্তী মুখ ঘুরিয়ে নেয়। নিজেদের কাঁচের ঘরটা চিনে বেশ কিছুক্ষণ পর যখন পৌঁছয়, তখন দেখে সেখানে অচেনা একটি লোক বসে আছে। লোকটি ওদের দেখে হাত বাড়িয়ে দেয়। তারপর বলে, আমার নাম মকবুল।

এই লোকটিকেই একটু আগে করিডরে দেখেছিল ওরা। কিন্তু আবছা, তরল অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারেনি। চেরাব ও দময়ন্তী লোকটিকে ভাল করে দেখে। এই তাহলে মকবুল! একটু আগেই মোক্ষের মুখে নামটা শুনেছে। মোটার দিকে ধাত, মাঝারি হাইট, হালকা গোঁফ, রাশভারি চেহারা। দেখলেই মনে হয়, কেউকেটা কেউ হবে।

মকবুল বলে, তোমরা দু-তিন পৃষ্ঠা লেখার পর আমাকে, অজিতেশকে বা অগ্নিমিত্রকে একবার দেখিয়ে নিও। আমরা তিনজন মিলেই অফিসটা সামলাই।

মকবুল চলে যায়। অজিতেশ, অগ্নিমিত্র আর মকবুল, এই তিনজনই ওদের বস! অজিতেশ কে? দময়ন্তী বুঝিয়ে দেয়, যে লোকটি ওদের ডেকে নিয়ে বসের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছিল...

ওই লোকটি এলেই আমি একটা দুর্গন্ধ পাচ্ছিলাম। চেরাব বলল। আর তা শুনে হো হো করে হেসে উঠল দময়ন্তী। তারপর বলল, বেহালার সুরের মতো? লোকটার কান কিন্তু খুব সজাগ। পোষা কুকুরের মতো হাবভাব। কিন্তু কানটা ঠিক তাক করে রাখে...

চেরাব প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, মকবুল বেশ হাসিখুশি, ভদ্র, আন্তরিক, তাই না? বেশ লাগল...

দময়ন্তী নিজের পুঁথি আর নির্দেশিকা গোছাতে গোছাতে বলে, আমার কিন্তু অগ্নিমিত্রকে বেশ লেগেছে। টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম।

চেরাব কিছু বলে না। অগ্নিমিত্রর নাম শুনেই ওর কেমন যেন অস্বস্তি হয়। লোকটির আচরণে মাধুর্যের অভাব আছে। একটু রুক্ষ। ঠিক যেন আন্তরিক আর বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। সবসময়ই কেমন যেন মেপে দেখছে। এরকম মানুষের সঙ্গে সে ঠিক সহজ হতে পারে না।

ওরা দুজনেই পুথি লেখায় মন দেয়।

 

১০

দময়ন্তীর একটু আগেই চেবার তিন পৃষ্ঠা লিখে ফেলল। তারপর প্রিন্টআউট নিয়ে চলল দেখিয়ে আসতে। উঠে দাঁড়াতেই সে বসের চেয়ারটাকে দেখতে পেল। চেয়ারটা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। পরে সে আবিষ্কার করেছিল, এই চেয়ারটার একটা অলৌকিক ক্ষমতা আছে। অফিসের যেখানেই যে থাকুক না কেন, তার মনে হবে, চেয়ারটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চেয়ারটাকে তখন আর ঠিক চেয়ার বলে মনে হয় না। কখনও মনে হয়, বারুদে ঠাসা বন্দুকের নল। কখনও বা সদাই প্রহরারত ক্যামেরা।

বাইরে থেকেই কাঁচের ঘরের ভেতর মকবুল, অগ্নিমিত্র আর সেই কদর্য লোকটিকে দেখতে পেল চেরাব। এই কদর্য লোকটিই অজিতেশ। সে আর মকবুল মুখোমুখি বসে আছে। অগ্নিমিত্র কোনও কাজে এই ঘরে এসেছে। সে দাঁড়িয়ে আছে আর হেসে হেসে অজিতেশের সঙ্গে কথা বলছে। মকবুল একটু বিচ্ছিন্ন, ওদের আলোচনায সে অংশ নেয়নি। আবার সেই দুর্গন্ধটা পাচ্ছে চেরাব। অজিতেশকে দেখলেই এই দুর্গন্ধটা পায় সে!

চেরাব ঘরে ঢুকতেই অগ্নিমিত্র কেমন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বলে উঠল, এসো, এসো, তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমরা...

অগ্নিমিত্রের কথাগুলো ঠিক রুচিকর মনে হল না চেরাবের। ওকে একা পেয়েই কেমন যেন ঠেস দিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে লোকটা। গোড়া থেকেই ওকে কোণঠাসা করে দিতে চায়। সে একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল। অগ্নিমিত্র প্রায় ছোঁ মেরেই ওর হাত থেকে লেখাটা নিয়ে নিয়েছেআড়চোখে একবার মকবুলকে দেখল চেরাব। কিন্তু মকবুল যেন কিছু শুনতেই পায়নি। শান্তভাবে সে একটি লেখা পড়ে যাচ্ছে। এবার সে অজিতেশের দিকে তাকাল। লোকটি কুৎসিতভাবে হাসছে।

কয়েকটা লাইন পরেই অগ্নিমিত্র বলে উঠল, না, কিস্যু হয়নি। এটা একটা লেখা হয়েছে?

চেরাব একটু অবাকই হল। কী বলতে চায় লোকটা?

তার ওপর অজস্র বানান ভুল। অগ্নিমিত্র বলে চলে, তুমি বানান জানো না? তেমন হলে, একটা ডিকশনারি নিয়ে বসো...

চেরাব টের পেল ওর ঠিক পিছনেই এসে দাঁড়িয়েছেন দময়ন্তী। আর তাতেই যেন ওকে দুরমুশ করার ইচ্ছাটা অগ্নিমিত্রের আরও বেড়ে গেছে।

এবার অগ্নিমিত্র ওর লেখাটা অজিতেশের দিকে বাড়িয়ে দিল। তারপর বলল, দেখুন তো, লেখাটা দেখুন একবার...

অজিতেশের চোখ দু-টো যেন সবসময়ই প্রচণ্ড ক্রোধে আর বিদ্বেষে জ্বলছে। সেখানে কোনও প্রশান্তি বা সৌন্দর্য় নেই। কালো, কুচকুচে, আলকাতরা মাখানো মুখটা রাগে থমথমে হয়ে আছে। সে হাসলেও মনে হয়, বানিয়ে বানিয়ে হাসছে। ওই মুখে হাসি মানায় না। শান্তি মানায় না।

অজিতেশও ঠিক কয়েকটা লাইনই পড়ল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, না, আপনি আবার লিখে আনুন।

অজিতেশকে দেখলে খুব হিংস্র মনে হয়। তার গলার স্বরেও সেই চাপা হিংসা। কিন্তু লোকটা খুব ভদ্র সাজার চেষ্টা করছে। আর এই ভদ্রতাটা ওর সঙ্গে খুব লাগসই হচ্ছে না। কেমন বেখাপ্পা লাগছে। লোকটা বস হয়েছে। আসলে খুব ইতর প্রকৃতির। কিন্তু বসদের নিজেকে ইতর দেখালে চলে না। সেটা পেশাদারিত্ব নয়। লোকটা তাই ভদ্র সেজে বসে আছে।

চেরাব নিজের ঘরে ফিরে আসে। রাগে ফুঁসছে সে। সে যেন ফেটে পড়তে চায়। গলা চিড়ে চেঁচিয়ে উঠতে চায়। কিন্তু কিছুই সে পারছে না। ওরা ওকে অপমান করল। আগে কেউ কখনও ওকে এত অপমান করেনি। ও কিছু বলতে পারল না কেন? লোক দু-টো ওর লেখাটা পড়েই দেখল না। কথাগুলো বলল বানিয়ে বানিয়ে। স্রেফ ওকে অসম্মান করবে বলে। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাসের ও সেরা ছাত্রদের একজন। ওকে এখন ভাষা আর বানান নতুন করে শিখতে হবে? তাও এই ইতর লোকগুলোর কাছে? ওর উচিত এক্ষুনি এই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাইরে খোলা আকাশের নিচে বেরিয়ে আসা। এই অপমান ও সহ্য করছে কেন?

একটু পরেই দময়ন্তীকে আসতে দেখল চেরাব। আর তখনই ওর মনে পড়ল, একটু আগে অপমানে ও এমনই কাঁপছিল যে, ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় দময়ন্তীর দিকে তাকায়নি পর্যন্ত! দময়ন্তী ওর দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু ও গ্রাহ্য না করেই দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসেছিল।

দময়ন্তীকে দেখে ও জানতে চাইল, তোমায় কিছু বলল?

নাঃ। দময়ন্তী চেয়ারে বসতে বসতে বলল, বলল তো, ঠিকই আছে।

দময়ন্তীর দিকে আড়চোখে একবার তাকাল চেরাব। দময়ন্তীর চোখে ও কী একটা ছোটো হয়ে গেছে? নইলে, দময়ন্তী একটু হলেও হঠাৎ কেমন পালটে গেছে কেন? ঠিক যেন, ওর চোখে চোখ রাখতে চাইছে না। নিজেকে একটু বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলছে।

চেরাব বলল, আমি একটু ক্যান্টিন থেকে ঘুরে আসছি।

দময়ন্তী এবার চোখ তুলে তাকায়। একটু চুপ থেকে বলে, ঠিক আছে।

তুমি যাবে?

নাঃ! দময়ন্তী ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে নিজের পুঁথির দিকে মন দেয়।

 

১১

ক্যান্টিনের দু-দিক দিয়েই বেরোনো যায়। চেরাব ব্যালকনিতে এল। হাতে চায়ের কাপ নিয়ে দূরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। এই সমুদ্রকে সে খুব ভালবাসে। একটু আগে সে অপমানিত হয়েছে। সমুদ্রই এখন তার সান্ত্বনা। তার পরিত্রাণ।

হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন তার কাঁধে হাত রাখল। চেরাব পিছন ফিরে দেখল, মকবুল আর মোক্ষ। চেরাবকে দেখে মকবুল একগাল হেসে বলল, ভুলটা কিন্তু তোমারই।

কেন?

লেখাটা তুমি অগ্নিমিত্রকে দিতে গেলে কেন?

চেরাব অবাক। প্রথমে একটা থতমত খেয়ে গেল। তারপর বলল, অগ্নিমিত্রই তো ফাঁকা ছিল। তুমি তো অন্য একটা লেখা পড়ছিলে। তাছাড়া...

মকবুল মিটিমিটি হাসছে। চেরাব বলে চলল, অগ্নিমিত্র তো লেখাটা প্রায় আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল...

এবার থেকে তুমি আমার হাতেই তোমার লেখা দেবে। মকবুল দৃঢ়স্বরে বলল।

চেরাব কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আজই এখানে তার প্রথম দিন। আর প্রথম থেকেই তাকে কৌশল করে চলতে হবে। নিজের আত্মরক্ষার কথা ভাবতে হবে। শত্রুর ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এরকম হবে কেন? এ তো অত্যন্ত অস্বস্তির ব্যাপার। এটা কোনও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নয়।

চেরাব জানতে চায়, কিন্তু অগ্নিমিত্র এ রকম করল কেন?

ও ওরকমই। মকবুল বলল, তবে দোষটা ওর নয়। আসল গোলমালটা করে রেখেছেন বস...

মানে?

আরে, ওর কোনও বিদ্যে আছে? কোনও রুচি আছে? কিন্তু বস ওকে বিশেষ স্নেহ করেন। ওই জায়গায় বসিয়ে রেখেছেন...

আর অজিতেশ? এবার জানতে চায় চেরাব।

মকবুলের মুখটা তীব্র ঘৃণায় বেঁকে যায়। তারপর বলে; ওই একটা লোক! ক্লাস নাইন পাশ। এদিকে অফিসের মাথা হয়ে বসে আছে। তবে আমাকে সমীহই করে। বিশেষ ঘাটায় না।

শেষ কথাটা বলার পর একটু পরিতৃপ্ত দেখায মকবুলকে।

আমাকে নিয়ে ওদের সমস্যাটা ঠিক কী? চেরাব আবার জানতে চায়।

তুমি শিক্ষিত ছেলে। ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ওরা শিক্ষিত লোকজন সহ্য করতে পারে না। আমি জানতাম, ওরা তোমাকে কোণঠাসা করতে চাইবে। কিছু ভেবো না। আমি তো আছি। আমি দেখে নেব ওদের...

চেরাব আবার চুপ করে যায়। প্রথম থেকেই দলাদলি। তবু সে একজন রক্ষাকর্তা পেয়েছে। মকবুল ওর রক্ষাকর্তা হতে চায়! কিন্তু একজন রক্ষাকর্তা নিয়ে টিকে থাকা মানে সে নিজের মেরুদণ্ড সোজা করে টিঁকে থাকতে জানে না। তার নিজের শিক্ষা বা যোগ্যতা তাকে বাঁচাতে পারবে না। বরং তার বিপদের কারণ হয়ে উঠবে। তার এখন একটা নির্ভরতা চাই। এই অক্ষম, পঙ্গু অস্তিত্বের দিকে এরা সবাই মিলে ঠেলে দিতে চাইছে তাকে। সে এখন কী করবে? এই জায়গাটা মোটেই ঠিক তার উপযুক্ত নয়। বরং গোড়া থেকেই অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে...

মকবুল চলে যায়। পিছন থেকে মোক্ষ এসে চেরাবের পাশে দাঁড়ায়। তারপর মৃদুস্বরে বলে, সবই শুনলাম। একটু খারাপই লাগছে। প্রথমদিনই ওরা শুরু করে দিল!

কে বলল তোমাকে? চেরাব জানতে চায়।

মকবুল।

চেরাব মোক্ষের দিকে তাকায়। মোক্ষ সবসময়ই গম্ভীর। কিন্তু তার আচরণ আন্তরিক। বন্ধুত্বপূর্ণ। সে যেন অনেক কিছু বলতে চায়। একজন সঙ্গী চায়। ওর সঙ্গে মেলামেশার উপযুক্ত সুযোগেরই অপেক্ষায় যেন ছিল সে।

মোক্ষ আবার বলে, মকবুলকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো। ও একজন ডক্টরেট। ওই বাকি দু-জনের মতো এলেবেলে নয়। শিক্ষিত লোক। শিক্ষিত লোককে কদর করতে জানে। তাছাড়া ও ম্যানেজমেন্টের অংশ। এই অফিসের একজন মাথা। বস ওকে খুব স্নেহ করেন।

চেরাব বলল, হ্যাঁ, ওর কথাবার্তা অন্য রকমের।

তাছাড়া এই কোম্পানির এখন যে এত সুনাম, সরকারের কাছে এত খাতির, এ সবের পিছনেও ওর একটা বড় ভূমিকা আছে। ওর অসম্ভব সাহস। দারুণ সব ঝুঁকি নিতে জানে। আর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। একটা ঘটনার কথা বলি। আমার একটা পুঁথি লেখা হয়ে গেছে। পরদিনই সরকারি দপ্তরে গিয়ে সেটা জমা দিতে হবে। বিকেলের দিকে একটা নতুন তথ্য পাওয়া গেল। অন্য কেউ হলে, তথ্যটা চেপে যেত। মকবুল বলল, ওটা জরুরি। ঢুকিয়ে দাও। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, অসম্ভব। সময় কই? মকবুল বলল, সারা রাত হাতে আছে। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। সেদিন রাত জেগে আমরা দু-জনে নতুন করে পুঁথিটি লিখলাম। তথ্যটা এমনই ছিল যে, পুঁথিটার আদ্যোপান্ত সংস্কার না করে উপায় ছিল না! মকবুল না থাকলে ওই ঝুঁকি নেওয়ার সাহস আমার হত না। পুঁথিটা সরকারি মহলে হইচই ফেলে দিল। ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ হল। বিদেশের চোখে আমাদের দেশের কদর বাড়ল। এই হল মকবুল! ওকে হেলাফেলার ভেবো না...

চেরাব বলল, নাঃ, এই চাকরিটা আমার ভাল লাগছে না...

চাকরি কার ভাল লাগে! হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল মোক্ষ। তারপর বলল, তুমি কী ভেবেছো আমরা এখানে সবাই ভাল আছি? কেউ ভাল নেই। কোনওমতে চালিয়ে যাচ্ছি। চাকরি না করলে আমার চলবে না। কিন্তু তোমারও কী তাই? তুমি তো ইউনিভার্সিটির ছাত্র...

নাঃ, আমার চাকির না করলেও চলবে। চেরাব গভীর তৃপ্তির সঙ্গে বলে ওঠে।

তাহলে ভেবে দেখ। সেটাই তো উচিত। আমি যেমন বেশিদিন আর এখানে থাকব না। ঠিক করেই ফেলেছি। আর কয়েক মাস। না, কয়েক মাসও নয়। বড়জোর দু-মাস। তারপরই ছেড়ে দেব। শুধু একটা বেটার চান্স পেলেই চলে যাব। আর যদি না পাই! তবুও এখানে আর থাকব বলে মনে হয় না। কিছুদিন না হয় চাকরি না করেই কাটবে! তারপর কিছু না কিছু জুটে যাবেই। এভাবে আর থাকতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু, তোমার যখন সুযোগ আছে...

এই কথাটায় চেরাব হঠাৎ শিউড়ে উঠল। সুযোগ সত্যিই তার আছে! কিন্তু সেই সুযোগ সে নিতে পারছে না কেন? কেন সে ওদের মুখের ওপর কিছু বলতে পারল না? চুপ করে রইল? কেন সে ক্রমেই আড়ষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে? কোণঠাসা হয়ে পড়ছে? কেন সে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এই মুহূর্তে এই অফিস ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারছে না? এই চাকরিতে তার কীসের প্রয়োজন? এই চাকরি সে তো চায়নি! সে কী ভয় পেয়ে গেছে? অথচ নিজের কাছেই সেকথা স্বীকার করতে পারছে না? লজ্জায় সে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। আর ভেতরে ভেতরে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে?

মোক্ষ বলে চলেছে, চাকরি করা মানে চাকর হয়ে থাকা। আর চাকরের তো কোনও ইচ্ছাশক্তি থাকে না। ডিগনিটিও থাকে না। মালিকের ইচ্ছাই তার ইচ্ছা। এতে মানুষের সাহস চলে যায়। মানুষ তখন ঝুঁকি নিতে ভয পায়। নিরাপদ, নিশ্চিন্ত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। চাকরি মানুষকে যন্ত্র বানিয়ে ছাড়ে। অথবা, আরশোলা। মানুষ তখন বুকে ভর দিয়ে চলে। অথচ টেরও পায় না। কিন্তু তুমি যদি জীবনে উন্নতি চাও, এখানে পড়ে থাকবে কেন? গোড়াতেই ডিসিশন নাও। তারপর নিজের পথে চলো...

তুমি কেন পড়ে আছো? চেরাব জানতে চায়। তুমি কি বিবাহিত?

নাঃ। আমি একা।

তাহলে?

আমার নিজের খরচ যৎসামান্য। কিন্তু বাবা-মা আছেন না? তাদের চিকিৎসার খরচ লাগে না? তাছাড়া সংসার চালানোর খরচ কী কম?

মোক্ষ ওর বন্ধু হতে চায়। চেরাব বুঝতে পারে। ইতিমধ্যেই মকবুল আর মোক্ষের ওপর মানসিকভাবে কেমন যেন ও নির্ভর করতে শুরু করে দিয়েছে। আজ সকালেই ওরা অচেনা ছিল। অথচ এখন শুধু চেনা নয়, নির্ভরতাও বটে! মানুষের জীবন কী অদ্ভুত!

চেরাব সমুদ্রের দিকে তাকায়। আর তখনই সে দেখতে পায় সেই কালো ঘোড়াটাকে। ঘোড়াটি কী ওর দিকেই তাকিয়ে আছে? ঠিক বুঝতে পারে না চেরাব।

নিচে নেমে ওরা দেখতে পেল বসের চেয়ার ঘিরে মিটিং শুরু হয়ে গেছে। সেখানে অজিতেশ, মকবুল আর অগ্নিমত্র। বিশিষ্ট সব মানুষ। সেখানে ওরা বাইরের লোক। ওদের কথা বলার কোনও অধিকার নেই। মতামত জানানোর কোনও সুযোগ নেই। শুধু বোবা হয়ে নির্দেশ পালন করে চলো।

চেরাব ভেবেছিল মিটিংয়ের সময় অন্তত বসকে দেখা যাবে। সে বলল, বস কই?

বসকে তো দেখা যায় না! লাজুক হেসে মোক্ষ জবাব দিল।

 

১২

চেরাব বলল, আজকের মতো কাজ তো শেষ। এবার তাহলে ওঠা যাক।

অনুমতি পেলে তবে ছুটি। দময়ন্তী আর চেরাব কাঁচের সামনে এসে দাঁড়াল। কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই মকবুল ওদের দেখে একগাল হেসে বলে উঠল, এসো তাহলে!

অজিতেশের ভ্রু কুঁচকে গেল। অগ্নিমিত্র তীব্র শ্লেষে বলে উঠল, তাহলে কাল চেরাব, তাই তো?

ওরা বাইরে এল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে।

চেরাব বলল, আমি তোমাকে এগিয়ে দেব?

খুব ভাল হয় তাহলে। দময়ন্তী বলল।

দময়ন্তী খুব ফরসা নয়। কিন্তু অদ্ভুত একটা আকর্ষণ আছে ওর মধ্যে। আকর্ষণ না মাদকতা? ঠিক বুঝতে পারে না চেরাব। কিন্তু ওর অসম্ভব ভাল লাগে। ওর মনে আর শরীরে সেই ভাল লাগার রেশ ছড়িয়ে পড়ে।

সমুদ্রের ধার দিয়ে ওরা হাঁটতে থাকে। তীব্র বাতাসে দময়ন্তীর চুল এলোমেলো হয়ে যায়। সেই চুল ওর সারা মুখে জড়িয়ে যায়। সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়, অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না। শুধু মাঝে মাঝে দময়ন্তীর গালের একটা ব্রণ ঝলসে ওঠে। তখন নিজেকে কেমন অসহায় মনে হয় চেরাবের।

দময়ন্তীর বাড়িটা ছোট একতলা বাংলোর মতো। বাড়ির ভেতরে একটা বাগান। সেখানে রয়েছে নানা ধরনের ফুলগাছ। বাড়িতে ঢোকার একটু আগে সমুদ্রের ধারে সারি দেওয়া নারকেল গাছ। দুটো নারকেল গাছের মাঝখানে একটা বেঞ্চ। সেই বেঞ্চে কেউ একজন বসে আছে। তার পিছনটা দেখা যাচ্ছে।

দময়ন্তী দেখেই বলল, বাবা!

ওখানে? চেরাব অবাক হয়।

সে অনেক গল্প। চলো, আলাপ করিয়ে দিই।

দময়ন্তীর বাবা এই ফাঁকা বেঞ্চে চুপ করে বসেছিলেন। ওদের দেখে মুখ তুললেন। ষাটের কাছাকাছি বয়স। দাড়ি কামাননি। চুল উসকোখুশকো। সারা মুখে বিষণ্ণতা। ম্লান চোখে তিনি ওদের দিকে তাকালেন। আলাপ-পরিচয়ের পর ওরা ফিরে এল।

বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে চেরাব বলল, তোমার বাবাকে একদম ভিক্টর ত্রিবেদীর মতো দেখতে।

কে ভিক্টর ত্রিবেদী? দময়ন্তী জানতে চাইল।

বাড়ির ভেতর ওরা ঢুকে এল। দময়ন্তীর বাড়িটা খুব সাজানো-গোছানো। ওরা বাইরের বারান্দায় এসে বসল। এখানেও একটা বেঞ্চ রয়েছে। সমুদ্রের বাতাস ওদের মুখে-চোখে এসে ঝাপটা মারছে।

চেরাব জানতে চাইল, তোমার মা কই?

দময়ন্তীর মুখটা হঠাৎ ম্লান দেখাল। একটু চুপ করে রইল সে। তারপর বলল, নেই। দেড়মাস হল মাত্র...

সে কী! চমকে উঠল চেরাব। কী হয়েছিল?

ক্যানসার। হঠাৎ ধরা পড়েছিল। তারপর থেকেই বাবার এই অবস্থা...

চেরাব কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারল না।

দময়ন্তী আবার বলল, বাবা খুব চেষ্টা করেছিল। খুব ভালবাসতো মাকে। আর নির্ভরও করত তেমন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না...

চেরাব কথা বলতে পারছে না। ওর নিজের বাবা-মা নেই। এই কষ্টটা ও বোঝে।

দময়ন্তী ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। বলল, বাবা খুব ভাল গান গাইত জানো। কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে একদম চুপ হয়ে গেছে। কথাই বলতে চায় না আজকাল। গান তো দূরের কথা! কোথায় কোথায় যে ঘুরে বেড়ায়! বাড়িতে থাকতে চায় না। বলে, এখানে থাকেল শুধু মায়ের কথাই মনে পড়ে...

চেরাব চুপ করে রইল।

দময়ন্তী বলল, এই বাংলোটা মাত্র বছরখানেক আগে কেনা। আগে আমরা একটা ফ্ল্যাটে থাকতাম। মা-ই এটা পছন্দ করেছিল। কত যে ফুলগাছ লাগিয়েছিল। বাংলোটা নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছিল। যার জন্য এতকিছু, সে-ই চলে গেল। বাবার কষ্টটা আমি বুঝতে পারি। মাকে বাঁচাতে চেয়ে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। তবু তো মাকে ফিরে পেল না...

চেরাব দময়ন্তীর দিকে তাকিয়েছিল। দময়ন্তীর অল্প বয়স। শোকটা সে অনেকটাই সামলে নিতে পেরেছে। তবু দময়ন্তীর প্রতি গভীর সমবেদনা বোধ করল সে। মায়ের মৃত্যু মেয়েকে নিশ্চয়ই খুব একা করে দিয়ে গিয়েছে। এই মেয়েটার পাশে থাকা দরকার।

হঠাৎ দময়ন্তী বলে উঠল, ভিক্টর ত্রিবেদী কে?

চেরাবের মুখে হাসি ফুটল। বেশ কিছুক্ষণ পর। তারপর সে বলল, জীবনে তাঁকে একবারই দেখেছি, জানো। কিন্তু কোনওদিনও ভুলতে পারব না। সে ছিল এক আশ্চর্য মানুষ...

দময়ন্তী কৌতূহল হয়ে তাকিয়ে আছে। চেরাব বলে চলল, এক বিখ্যাত শিল্পীর কাছে মাঝে মাঝে আমি আমার আঁকা ছবি দেখাতে যেতাম। তিনি আমাদের বাড়ির কাছেই থাকতেন। কিন্তু সেই প্রবীণ শিল্পী বিখ্যাত হলে কী হবে, তাঁর মনটা তেমন দরাজ ছিল না বলেই মনে হয়। সবসময় তিনি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। আমার ছবিগুলিকে তিনি তেমন আমলই দিতেন না। তেমন গুরুত্ব নিয়েও দেখতেন না। হেলাফেলায় একবার চোখ বুলিয়েই আমার কাছে ফিরিয়ে দিতেন। আমি তাঁর মতামত শুনতে চাইতাম। কিন্তু তিনি কোনও কথাই বলতেন না। কেমন যেন করুণা করতেন আমাকে। যেন আমি কোনও মতামতের যোগ্যই নই!

দময়ন্তী তাকিয়ে আছে। চেরাব বলে চলে, একদিন সেই বিখ্যাত শিল্পীর বাড়িতে গেছি। দেখি, তাঁর কাছে একজন রোগা, ঢ্যাঙা লোক বসে আছেন। বিখ্যাত শিল্পী তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলেন। এই লোকটিই ভিক্টর ত্রিবেদী। লোকটি খুব সরেস। মজার মজার কথা বলে বেশ জমিয়ে রাখছিলেন। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলাম, রসিক হলেও লোকটির মধ্যে হতাশা আছে। মাঝে মাঝেই তিনি বলে উঠছিলেন, আমি একজন ব্যর্থ শিল্পী। এখানে আসি স্রেফ শিখতে। বিখ্যাত শিল্পীর স্বভাবই হল, নিজেকে সবসময় তিনি অনেক উঁচুতে রাখেন। আর সেই উচ্চতা থেকেই অন্যদের দেখেন। ভিক্টর ত্রিবেদীর কথা শুনে তিনি হাসছিলেন ঠিকই কিন্তু তেমন একটা গুরুত্ব দিচ্ছিলেন বলে মনে হয় না।

দময়ন্তী বলল, এইসব মানুষের কাছে গিয়ে কোনও লাভ হয় না। এরা নিজেরাও অন্ধ। কাউকে পথও চেনাতেও পারেন না।

চেরাব বলে চলল, দশ-মিনিট কেটে গেছে। একটু ইতস্তত করে আমি আমার নতুন ছবিটা বার করলাম। একটা সুড়ঙ্গের ছবি। তারপর এগিয়ে দিলাম সেই বিখ্যাত শিল্পীর দিকে। তিনি তখন রসের গল্পে মজে আছেন। আমার ছবিটা যথারীতি হেলাফেলা করেই দেখলেন। ভিক্টর ত্রিবেদী কিন্তু হঠাৎ চুপ করে গেল। তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন আমার ছবিটার ওপর। নিজেই আগ্রহ নিয়ে চেয়ে নিলেন ছবিটা। তারপর বেশ কিছুক্ষণ একাগ্র হয়ে তাকিয়ে রইলেন ছবিটার দিকে। নিজের মনেই বিড়বিড় করতে লাগলেন, সাধারণ নও, তুমি তো সাধারণ নও বাপু...

দময়ন্তী চুপ করে গেছে। খুব আগ্রহ নিয়ে গল্পটা শুনছে। চেরাব বলে চলল, আমি দেখলাম বিখ্যাত শিল্পীর ভ্রু কুঁচেক গেছে। একটু যেন বিরক্তই তিনি। বিব্রতও বটে! ভিক্টর ত্রিবেদী যেন ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাসে মুখ দিয়েছেন। তিনি সবই শুনতে পেয়েছেন। তবু না শোনার ভান করে চেঁচিয়ে উঠেলন, কী বলছ তুমি ভিক্টর? আসলে তিনি শাসন করতে চাইছিলেন। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হল। ভিক্টর ত্রিবেদী এবার বেশ জোরে জোরে বলে উঠলেন, এ ছেলে কোনও সাধারণ শিল্পী নয় দাদা। এ ছেলে অসাধারণ। এর ব্যাপারে একটু যত্ন নেবেন।

কিন্তু বিখ্যাত শিল্পীর চোখ দুটো তখন জ্বলছেতিনি কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে বললেন, পরে এসো, কেমন? এখন তো একটু ব্যস্ত আছি! আসলে তিনি খুব অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তিনি আমাকে শুধুই হেলাফেলা করে এসেছেন। ভিক্টর ত্রিবেদী যেন তাঁকে শাস্তি দিয়ে গেলেন।

দময়ন্তী বলল, ভিক্টর ত্রিবেদী এখন কোথায়?

চেরাব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তিনি মারা গেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার আর কখনও দেখা হয়নি। কিছুদিন পর সেই বিখ্যাত শিল্পীর মুখেই খবর পেলাম, ভিক্টর ত্রিবেদী আর নেই। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে তিনি মারা গেছেন। ভিক্টর ত্রিবেদী আমার জীবনে এক প্রেরণা। বোধহয় সবচেয়ে বড় প্রেরণা। তিনি বিখ্যাত হতে পারেননি। কিন্তু তাঁর একটা অন্তর্ভেদী চোখ ছিল। আর ছিল একটা দরাজ মন। তিনি ছিব দেখতে জানতেন। আর তাকে স্বীকৃতি দিতেও পিছপা হতেন না। বিখ্যাত শিল্পীর মতো মানুষ আমি অনেক দেখেছি। এরা নিজেদের ছোট ছোট সাফল্যের জন্য মানুষ খুন করতেও পারেন। এতটাই ইতর প্রকৃতির এরা। কিন্তু ভিক্টর ত্রিবেদীর মতো মানুষ আর একজনও দেখিনি। কী সুন্দর কথা বলতেন তিনি। কী গভীর দরদ নিয়ে আমার ছবিটাকে দেখেছিলেন। আর কী খোলা মন নিয়ে তার প্রশংসা করেছিলেন। ওই প্রশংসা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, আমার মতো তুচ্ছ মানুষকেও তিনি হেলাফেলা করেননি। বরং নিজের মতো করে সেই তুচ্ছ মানুষটিকে আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন! এখনও সামান্য অপমানিত হলেই আমার ভিক্টর ত্রিবেদীর কথাই মনে হয়। আজ সারাদিন তাঁকে ভুলে ছিলাম। তোমার বাবা আবার তাঁকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন

চেরাব উঠে দাঁড়ায়। এবার তাকে ফিরতে হবে। অনেক রাত হয়েছে।

সমুদ্রের ধার দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সেই বেঞ্চটার দিকে তাকায় চেরাব। দময়ন্তীর বাবা ঠিক একইভাবে বসে আছেন। ঠিক যেন একটা পাথরের মূর্তি! কখন ফিরবেন কে জানে! ভিক্টর ত্রিবেদী মারা গেছেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর ছবিগুলো তো রয়ে গেছে। সেই ছবিগুলি তাকে খুঁজে বার করতে হবে। এটাই হবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ।

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে দময়ন্তী বলেছিল, কাল তাহলে দেখা হচ্ছে...

আমি ভিক্টর ত্রিবেদীর ছবিগুলিকে খুঁজে বার করব। হঠাৎ বলে ওঠে চেরাব।

কেন? দময়ন্তী একটু অবাক হয়েই জানতে চায়।

শুধু শুধু বেঁচে কী হবে? জীবনের একটা উদ্দেশ্য থাকা দরকার, তাই না?

তুমি ঠিক আমার বাবার মতো কথা বলছ। দময়ন্তী বলে।

আর তুমি? তোমার এরকম মনে হয় না?

নাঃ। দময়ন্তী হেসে ফেলে। তারপর বলে, আমার মনে হয় কী জানো?

কী? চেরাব জানতে চায়।

দময়ন্তী মৃদু হাসে। তারপর বলে, অত উদ্দেশ্য খুঁজেটুজে লাভ নেই। ওতে স্রেফ সময় নষ্ট হয়। মনখারাপ হয়। জীবন তখন বোঝা হয়ে ওঠে। ঘাড়ের ওপর চেপে বসে। আমার বাবার যেমন হয়েছে! জীবন তো একটাই। সেই জীবনটাকে নিজের ইচ্ছামতো চালাও। তোমার হাতেই স্টিয়ারিং থাকবে। তুমিই জীবনকে চালাবে। তুমি যেমন বলবে, জীবন সেভাবেই চলবে। জীবনকে বশে মানাতে হবে। আর তার জন্য নিষ্ঠুর হতে হবে। তুমি বড় বেশি আবেগপ্রবণ। কবেকার কোন এক স্মৃতি, তাকে পোষা বেড়ালের মতো পুষে রেখেছ। আমি হলে কবেই ওকে ঝেটিয়ে বিদায় করতাম...

চলি, দময়ন্তী। চেরাব বলে। তারপর অন্ধকারে মিশে যায়।

পিছন থেকে দময়ন্তী চেঁচিয়ে ওঠে, ভিক্টর ত্রিবেদীকে নিয়ে সময় নষ্ট করো না চেরাব। সে তোমার ঘাড়ে চেপে বসেছে। কাউকে নিজের ঘাড়ে চাপতে দিয়ো না...

চেরাব কিছুই যেন শুনতে পায় না। শুধু ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, ভিক্টর ত্রিবেদী, তোমাকেই এখন আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সবার চেয়ে বেশি। তোমাকে ছাড়া এই চাকরিটা করতে পারব না আমি...

 

                                                                    ক্রমশঃ-

No comments:

Post a Comment