বাক্‌ ১৪৫ ।। ব্যক্তিগত দর্শন : বাক্ স্বাধীনতা— ৫ম- পর্ব ।। শুভদীপ নায়ক

জীবন হল এক অধিকৃত এলাকা । সেই জীবনের অস্তিত্ব, বিপন্নতা, প্রেম, সৃষ্টি ও দার্শনিক সব জিজ্ঞাসাই উপলব্ধি ও চক্ষুজ্ঞানের কাছে তালাবন্দি হয়ে পড়ে থাকে । মানুষ সম্পর্ক, প্রভুত্ব, সৌজন্যের মাধ্যমে দখল নিতে থাকে অন্য মানুষের স্বাধীনতাকে । বিশেষ করে একটি স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা যা শৈশব থেকে একজন মানুষকে শিক্ষা দেয় কী তুমি দেখতে বাধ্য, কী তুমি বলতে বাধ্য । রাষ্ট্রের সেই সময়কাল দ্বারা একজন শিশু সূচিত হয় যে সময়ে তার জন্ম, সেই সময়ে বেঁচে থাকার প্রথম প্রয়োজনীয়তাটা ঠিক কী, সেটা জানতে । শিশু হয়তো বেছে নেয় আজীবন দাসত্ব, যেখানে মূল্যবোধ জমা রাখা হবে জীবনের কিছু শর্তের বিনিময়ে । তাকে বলা হয়, তার শিক্ষা হবে স্রেফ নৈতিকতা, সেখানে মৌলিক প্রশ্ন ও জীবন জিজ্ঞাসা থাকবে না । তাকে বেছে নিতে একটা জীবকা, যার বিনিময়ে সে সংগ্রহ করতে পারবে রুজিরুটি, সে পাবে আইনের সুরক্ষা, সামাজিক মর্যাদা । কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার যোগদান থাকলেও সেখানে থাকবে না কোনও অধিকারবোধের প্রতিষ্ঠা । অপরদিকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার প্রশ্নে থাকে ছোটখাটো ফাটল, নিরাপদ চাবি, বাইরে ও ভিতরে নানাবিধ শক্তির ধমক, পায়ের তলার জমি হারানোর ভয়, একাকিত্ব, কষ্ট, দেশভাগের জ্বালা ইত্যাদি । শিশু যদি এসব গ্রহণ করে, সে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে নিজেরই জীবনে । আজীবন দাসত্ব করার পরিবর্তে সে শুরু করে লড়াই, ভিতরে নিজের সঙ্গে, বাইরে সমগ্র পৃথিবীর সঙ্গে । কবি হিসাবে সেই শিশু যদি সমাজতন্ত্রের ক্রুশকাঠ পিঠ নিয়ে হাঁটে, সমাজই তাকে তার সমস্ত অবদান থেকে একদিন পরিহার করে । কবি হিসাবে, লেখক হিসাবে যে কোনও ব্যক্তি ঈশ্বরই তাঁর লেখা থেকে নির্বাসিত হন । এই নির্বাসন শুধু এই জন্যেই, মনুষ্যত্বের পথে আমি কাজ করছি 'অনন্ত অজানা'-র বা The unknown infinity-এর জন্য।

 

হঠাৎ একদিন স্বপ্নে আমি দেখতে পেলাম, স্কুলে যাওয়ার জন্য আমি দেরি করে ফেলেছি । আমাকে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে তুলে স্কুল ইউনিফর্ম পরিয়ে স্কুলে পাঠানোর একটা চেষ্টা চলছে । আমি বুঝলাম স্কুল হল সেই শাসিত এলাকা যেখানে একটি নির্দিষ্ট পোশাক ছাড়া আমার প্রবেশাধিকার নেই । শ্রেণিকক্ষে পৌঁছে দেখলাম সকলে একইরকম মুখোশ পরে । তারা কেউ পরস্পরকে চেনে না, বলা বহুল্য আমাকেও তারা চিনতে পারছিল না । যদিও আমার মুখে কোনও মুখোশ ছিল না, তবু আমার মনে হল তারা আমার মুখে ঐ রকম একটা মুখোশ দেখার জন্য ভিতরে ভিতরে উৎসাহ বোধ করছে । সকলে মুখোশ পরে থাকার জন্য আমি শিক্ষককে খুঁজে পাচ্ছিলাম না । আমার মনে হল, শিক্ষকও ঐ ছাত্রদের মধ্যে লুকিয়ে বসে রয়েছে । এবং জীবনের পরবর্তী সময়গুলোতে দেখেছি এই স্বপ্ন, যার দৃশ্য চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল আমার ভিতর থেকে, কিন্তু তার একটা মৌলিক অবদান আমার পারিপার্শ্বিক বিশ্বজগতে রয়ে গিয়েছে । স্কুল থেকেই আমরা মুখোশ পরতে অভ্যস্ত হই । আমরা যার মধ্যে বেঁচে থাকি সেই মুখোশ আমাদের এই প্রতিপদে বেঁচে থাকার হয়ে ওকালতি করে, এটা জানা সত্ত্বেও যে আমাদের প্রকৃত মুখকে এই মুখোশ সর্বদা আড়ালে রাখে, তবু আমরা সেই মুখোশের হয়ে সমর্থন দিতে পিছু পা হই না।

 

আমার বাইরে যেসব পায়ে হাঁটা পথ ছিল, আমি তা অতিক্রম করতে লাগলাম । ভাবলাম, শৈশব শেষ হবে এমন একটা আশাবাদিতায়, নোঙর যেখানে চিরকালীন একটা আশার প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকতে পারে । একটা বিবর্ধিত চিত্রকল্প, যেখানে সকল সৃষ্টির প্রতিধ্বনি নতুন করে জাগরিত হবে । এখানে স্যুরিয়ালিস্ত কবিদের কথা স্মরণ না করে আমি থাকতে পারি না । শিল্পের স্বার্থে ভুল দেখা, কিংবা ভুল বাঁচা, কিংবা হতাশায় ডুবে থাকাও আসলে স্বীকৃতিমূলক । এই জীবনযাপনের সঙ্গে কোথাও একটা পরাবস্তব যোগসূত্র আছে নিজস্ব অন্তর্লীন অভিঘাতের । এই বহতা জীবনের মধ্যে ভেঙে পড়ে অনুষঙ্গের স্বয়ংক্রিয়তা,  দুর্দান্ত গতির মধ্যে যা বসিয়ে দেয় দারুণ স্থিতিকে । এই juxtaposition of imagery থেকেই সৃষ্টি হয় একজন শিল্পী কিংবা কবির চিন্তা ও চেতনার পথ । তিরিশটিরও বেশি গ্রীষ্মকালের তাপ ও শীতাকালের বেদনা নিয়ে যা আমি সংকলিত হতে দেখেছি । আরম্ভবিন্দুর স্বকীয়তার কারণেই আমরা এই রিয়্যালিটিতে পৌঁছতে পারি না । দার্শনিক হেগেল বলেছেন, 'স্বর্গে বা পৃথিবীতে এমন কিছুই নেই যার ভেতরের সত্তায় বা শূন্যতায় অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব ব্যাপারটা ধরা থাকে না । এই অপচ্ছায়া জীবনের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় চলতে থাকে।'

 

আধুনিক অস্তিত্বের এই অসঞ্জীবিত বাস্তবতার সংশ্লেষণকে আমি অর্জন করলাম ধীরে ধীরে । তাৎপর্যগতভাবে যা আমাকে নিয়ে গেল তুমুল সৃষ্টিশীলতায় । কাব্যের দুর্দশাকে ভুলে যাওয়ার কোনও অধিকার যেহেতু আমার নেই, তাই আমি অভিব্যক্তি ঘটালাম আমার চারপাশের লেখার পরিবেশটির । কতকটা সময় পেরিয়ে সেখানে অন্ধকার নেমে এল । আমার লেখালিখি আড়াল হয়ে ফিরে পেল তার নিজস্ব নির্জনতা, যা নিয়ে তাকে প্রতিষ্ঠা পেতে হবে চিরকালীন সাহিত্যে । এই আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে আমি বিচ্ছিন্ন হলাম আমার সমকালীন লেখকদের সঙ্গে । সম্পূর্ণ সচেতন অবস্থায় যা আমাকে ছুঁড়ে দিল একটা গভীর চেতনার দিকে । আমি এসে পড়লাম পথিকৃৎদের সভায়, যেখানে সাহিত্যে আলোচনা হয় জীবনের সারবস্তু নিয়ে । আমি বললাম, এই আমার আসা ! এই হচ্ছি আমি!

 

আরেক ধরণের ইউটোপিয়াকে যদি বিশ্লেষণ করতে হয় নিজের ব্যাপারে, তা হলে সেখানে আমি ট্রান্সট্র্যোমারের 'অন্ধকারের দেখা' কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কিছু কথা বলতে পারি । পক্ষাঘাতে জর্জ্বরিত এই কবির কিছু কথা, যা আমাকে লেখার টেবিলে বারবার ফিরিয়ে এনেছে, তা হল--'দুটি সত্য পরস্পরের দিকে ধাবমান । একটি আসে ভেতর ও অন্যটি আসে বাইরে থেকে, এবং যেখানে তারা মিলতে চায়, সেখানে তোমার সুযোগ আছে নিজের দিকে তাকানোর ।' দর্শন ও সাহিত্যের ইতিহাসে আমরা যদি কিয়ের্কেগার্দ, নীৎসে ও দস্তয়েভস্কির লেখার চিত্রকল্পকে দেখি, তা হলে কোথাও এটা বুঝতে বাকি থাকে না যে কল্পনার জগতে শুধুমাত্র নান্দনিকতারই নয়, বরং স্থান রয়েছে নৈতিকতারও । একইসঙ্গে ঘটতে থাকে সময়ের ফিউশান ও জীবনের রূপান্তর । এখানে আপ্ত-প্রশ্নের নিরিখে কিছু কথা উঠে আসে । একজন লেখক যখন তাঁর সময়ের সবচেয়ে সেরা লেখাটা লেখার প্রস্তুতি নিতে থাকে, তখন সে এটাও জানে তাঁর সম্পূর্ণতাটা সে ঐ লেখাটিতে নিয়োজিত করতে পারব না । বেশিরভাগটা সে ঐ লেখাটিকে দিতেই পারে । কিন্তু ফাঁক থেকে যাবে পরিপূর্ণতা প্রদানের জায়গাটিতে । সত্যি বলতে এই অসম্পূর্ণতা, এই বাকি থেকে যাওয়া অংশটি তাঁকে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় আবিষ্কারের পথ ধরে, যেন লেখাটি তাঁর রচয়িতাকে ভূ-গর্ভস্থ অন্ধকার থেকে টেনে তুলছে একটা কাল্পনিক সিঁড়ি দিয়ে । একটা বইয়ের জন্ম ঠিক এমনই অন্ধকার থেকে হয় । সে বই যতই আলোর মলাটে বিক্রি হোক না কেন, তার ভিতরে থাকা লেখাগুলো যাত্রা করেছে এমন একটা জায়গা থেকে যেখানে পাঠকের পরিপূর্ণ প্রবেশের হয়তো অনুমতি নেই । পাঠক বইটির লেখা পড়তে পারে, বুঝতে পারে, যাপন করতে পারে লেখাটির সঙ্গে, কিন্তু লেখাটির সঙ্গে জীবনের যে অবিচ্ছেদ্য কাহিনি, পাঠক তার মধ্যে প্রবেশ করবে কী করে ? যদি লেখাটি কোনও গল্প বা উপন্যাস হয়, পাঠক অন্তত তাতে একটি চরিত্রের মধ্যে দিয়ে কাহিনিতে নিজের জায়গা খুঁজে পেতে পারে, কিন্তু লেখাটি কবিতা হলে ? পাঠক সেখানে পথ হারিয়ে, সর্বস্ব হারিয়ে ভঙ্গুর হতে বাধ্য।

 

অনেক জীবন পরে আমার কাছে যে প্রশ্ন ধরা দিল, তা যেন নিজেকেই জিজ্ঞাসা করার নামান্তর । আমি কে ? কবিতার মধ্যে দিয়ে যখন নিজেকে প্রকাশ করি, কবির ভূমিকায় উত্তীর্ণ হই । কিন্তু গদ্য লেখার সময় গদ্যকার হিসাবে আমি নিজেকে খুঁজে পাই অন্য চেতনার মধ্যে দিয়ে । দার্শনিক জিজ্ঞাস্যের মুহূর্তে ফুটে ওঠে আমার সম্পূর্ণ অন্য পরিচিতি । এই বিভ্রান্তিকর বহুরূপী চরিত্রের মধ্যে থেকে নিষ্কৃতি পেতেই আমাকে বেছে নিতে হয়েছে নিজস্ব একটি দর্শন, যা আত্মকথার মতোই, কিন্তু আসল অর্থে তা আরও অন্য অনেকের কথা।

 

ভারতবর্ষের মতো একটা বিশাল জনসংখ্যার দেশে গভীর চেতনার মানুষদের দুর্বোধ্য বলে বিবেচিত করে প্রান্তিক করে রাখা হয় । তা না হলে মধ্যমেধার স্থান কখনও প্রথম সারিতে উঠে আসতে পারে না । কিংবা নিদেনপক্ষে মেধারও মাপকাঠি বজায় রাখতে সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়কৃত ডিগ্রিকেই বেছে নেওয়া হয় । যুগকে মূল্য দিতে যেসব শিল্পী কিংবা সাহিত্যিকদের আবির্ভাব হয়, তারা বিকশিত হয় অনেক দেরিতে । সবটা বদলে যাওয়ার অনেক পরেই মানুষ তাঁদের অবদান সম্পর্কে বুঝতে পারে । তাই সর্বপরি বলা যেতে পারে, যে চিন্তকের চিন্তাধারায় অনুপ্রবেশ বেদনাময়, কষ্টকর, সেখানে তাঁর নতুন জন্মও হতে পারে, কিংবা মৃত্যুও ঘটতে পারে । কিন্তু তাঁর সেই মৌলিক সৃষ্টির অনিবার্যতাকে মুছে ফেলতে পারে না সময়ের নতুন চিত্রনাট্য এসে । যেভাবে সেই স্বপ্নে দেখা স্কুলে আমাকে মুছে ফেলতে পারেনি অন্যান্য মুখোশধারী ছাত্রেরা। ঘুম ভেঙে প্রভাতে আমি সেই স্বপ্নের কথা ভেবে আশ্চর্য হয়েছিলাম। আজ মনে হয়, সেইসব মৃতেরা আমাকে যেন চিরকাল কিছু বলতে চেয়েছে যা আমাকে জীবিতরাও কখনও বলে উঠতে পারেনি।

 

(চলবে)

6 comments:

  1. ভালো লাগলো। ঝরঝরে গদ্য। আগের পর্বগুলি পড়ব।

    ReplyDelete
  2. অসামান্য লেখা। আর স্মার্ট গদ্য!
    অনেক ভালোবাসা রইল।

    ReplyDelete
  3. অসাধারণ লেখা

    ReplyDelete
  4. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  5. মুগ্ধ হয়ে পড়লাম।

    ReplyDelete