বাক্‌ ১৪৫ ।। অনুসরণমঙ্গল ।। শুভংকর গুহ

 

পায়ে চলার দাগ যেমন একদিন পথে পরিণত হয় তেমনিই মাটিতে পড়ে থাকা দাগ জনপদের দিকে ধাবিত হয়। পথের দাগ মন্দিরতলার, গ্রামের চৌমাথা, হাটের মাঠে থেমে গেলেও অন্যদিকে আবার শাখা বিস্তার করে। এই তল্লাটের মানুষের নিবারণের বাড়িতে আসার উদ্দেশ্য এক নয়। কেউ আসে লাঙ্গল তৈয়ারির শিক্ষা নিতে, কেউ আসে নিবারণের ভাবের কথা জানতে। কেউ আসে মইয়ের দুই পাশের ফোঁড়বাঁশের চরিত্র জানতে। কিন্তু কাজের কথা জানতে জানতে কেশবনন্দনের মতো নিবারণের ভাবের ঘরে কেউ হাত দেয় না। লাঙ্গল আগড় ও মইয়ের মতো ভাবের কথা জানাও যে জরুরি। ভাবের কথায় মানুষ যে চিরকাল তৃপ্তি পেয়ে এসেছে।  

বৈশাখ জ্যৈষ্ঠে তরমুজ, শসা ও ফাটাফুঁটি পথের ওপর থেকে সারানো হয় নি। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস এখন   বাবুইপাখির বাসার ভিতরে অবস্থান করছে। নিবারণ ফুঁটি তরমুজ জামরুল কাঁঠালের বিচিগুলিকে আলাদা সরিয়ে রাখছিল টোকরিতে। শুকিয়ে গেলে নোড়া দিয়ে থেঁৎলে নানান পশু পাগারের ভুতের চিত্র অঙ্কন করবে।

গতবার আলের সীমানা প্রসারিত করে ঠকেছে।

যতদূর চোখ যায়, সবটাই তাদের খাস জমি। জ্যোৎস্না জেগে উঠলে আলের একটু শূন্য পরিসরে খড় ফেলে রাখলে পারসে এসে ঠুকরোবে। আলের ফাঁকে ঘুনি কাদামাটি পেতে রাখলে, জলশিউলির শিকড় ফেলে রাখলে, পূর্ণিমার রাতে শিকড় খেয়ে মাতোয়ারা হয়ে, আমোদে হোপলে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়বে। 

বেলা মধ্যম হয়ে এলে, মনের মধ্যে উচাটন খোঁচা দিয়ে যায়। মনে হয় জীবনের কত কৃষিকাজ পড়ে  থাকল। পশ্চিমপ্রান্তে শ্মশানের দিকে যাওয়ার দুইধান দূরে জনপদ ফুঁড়ে উঠেছে। পাকাবাড়ি গড়ে উঠছে ভুঁইফোড় বণিকদের। মশলাপাতি, সুতো, কাঠ, টালি, কাঁসা পিতলের কারবারি। তল্লাট ভরে যাচ্ছে বহিরাগতদের বসবাসে। নানান দেশ ও গঞ্জের মানুষজন। ঘন ঘন বসছে দেওয়ান পাড়াতে ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর। সাধু সন্ত আসছেন গান গাইতে। দেওয়ান দিঘির জলে এসরাজের মেঘমল্লার ও ভৈরবীর রাগ স্রোত এঁকে দিচ্ছে। সাহেব আসে,  ইউরোপের সাদা দম্ভে, মগ্ন হয়ে নতজানু হয় ভারতীয় রাগ সঙ্গীতে – ভক্তিগানে।

সংবাদটি ছড়িয়েছে। কাপাস ফুলের মতো ভেসে। পারবাসুদেবপুরের সীমানা অতিক্রম করে, বেলঘরের জমি চিড়ে দিয়ে রেললাইনের কাজ শুরু হবেকোম্পানির লোকজন এসে তাঁবু ফেলেছে। কলকাতা থেকে রেললাইন যাবে কুষ্ঠিয়া পর্যন্ত 

আগে এইসব ফেরিওয়ালা দেখা যেত না। নতুন নতুন ফেরিওয়ালা আসছে যাচ্ছে। নতুন নতুন সব জিনিস নিয়ে আসছে। মহিলাদের নানা রঙয়ের মখমলের মতো চুলের ফিতে। ডোরাকাটা কাঠের রূপার চিরুনি। শৌখিন সব লন্ঠন কুপি কারবাইডের বাতিস্তম্ভ, মোমদানি, মধুপাত্র, পিতলের আলপনা খচিত হুঁকো। বিলাসচরণ বিদেশি হুঁকোতে জলের ভগভগি তুলে, সেক্সপীয়রের নাটক পড়তে পড়তে, আলেজেন্দ্রিয়া শহরের প্রাসাদে বিচরণ করে মরূদ্যানের গুল্মলতা দেখে সঞ্চিত মোহর গুনতে গুনতে ভাবে, কবে যাবে সেক্সপীয়রের সমাধিস্থলে।

নিবারণের ভুল ভাঙ্গল অনেকক্ষণ পরে। না ভিনদেশি ফেরিওয়ালা নয়। মাথায় ঝুড়িতে চাপিয়ে কে যেন  এগিয়ে আসছে। হাতে গাছের চারা। দিগম্বরের চেহারাটি বেশ হয়েছে। হাঁটাচলায় কেমন এক গতি এসেছে। অনেকটা মাতব্বরদের মতো। ধূতি আর হাঁটুর ওপরে নয়। ধবধবে সাদা ধূতি ও ফতুয়া। দুধেল বকের মতো সাদা পোশাক। দিগম্বর গাছের ছায়া নিয়ে নিয়ে আসছিল। নিবারণের সামনে এসে দাঁড়াতেই, নিবারণ উঠে দাঁড়িয়ে তার মাথার থেকে বোঝা ধরে বলল, -- তা হলে তোমাকে বেইলি সাহেব ছুটি দিল ?  

এই নাও। সেগুন গাছের চারা দিলেন সাহেব। বললেন, উঠোনে পুঁতে দিতে। ভবিষ্যতে লাভ দেবে। ছুটি কোথায় ? আমাদের কি কাজের শেষ আছে দাদা। গ্রাম গড়ে উঠছে। জনপদের বহর বাড়ছে। নতুন নতুন নামকরণ হচ্ছে। চারধারে নতুন বসবাসের উৎসব লেগেছে। সাহেবের মধু খাওয়ার ইচ্ছে হল। নিজেই লোক নিয়ে গেল চাক ভাঙ্গতে। আর কি, মৌমাছি সাহেবের মসৃণ চামড়া পেয়ে সখ্য করে নিল। এমন কামড়াল, সাহেবের জ্বর এসেছে বিভূতি।

কাঠমাছি ? 

হ্যাঁ। কাঠমাছি

হাটেও মধু পাওয়া যায় দিগম্বর। সেখান থেকে কিনে সাহেবকে দিতে পারতে ? সেনের আড়ার হাটে ভালো মধু পাওয়া যায়, তা তুমি ভালো করে জানো। বিদ্যাধরী নদী ধরে আসে সোঁদরবন থেকে।

তুমি জানো না। মধুতে এখন ওরা আঁখের গুঁড়ের জল মিশিয়ে দেয়। চেখে বোঝো না, কেমন পানসে লাগে। সেই সব দক্ষিণের মধু ব্যবসায়ীরা আর নেই।

সাহেব তো জানে না কাঠমধু কতটা হিংস্র হয়।

সাহেব ওসব শোনে না। শুনেও পরোয়া করে না।

সাহেবখানায় গিয়ে তোমার চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

সাহেবখানা বোলো না। বলো মানচিত্র জরিপের মন্দির। ভূমি নদী খাল পুকুর দিঘি ও জনপদের যিনি মানচিত্র করেন তিনি জমিদাগের সাধক। তিনি কোনো খানায় থাকেন না। তিনি থাকেন আমাদের থেকে অনেক উঁচু স্থানে। তিনি মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের ভক্ত। কি নিষ্ঠায় তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। না দেখলে ওজন করতে পারবে না। একবার তোমাকে নিয়ে যাব। দেখে আসবে।

সেগুন গাছের চারা নিয়ে এলে যে ?

নিয়ে এলাম, সাহেব পাহাড়ি জঙ্গলে গেছিলেন। সেখান থেকে সংগ্রহ করেছিলেন বেশ কয়েকটি  সেগুনের চারা। আমাকে একটি উপহার দিলেন। বললেন,-- বাড়ির জমিতে একবার পুঁতে দাও। এখানকার জল বাতাসে যদিও হওয়ার নয়, কিন্তু যদি হয়, তা হলে রাজ্যপাট ফেঁদে বসবে।

নিবারণ হাসতে হাসতে বলল,-- সাহেবরা যেমন ফেঁদে বসল।

দিগম্বর অনেকদিন পরে এল বলে, নিবারণের উঠোন জুড়ে আলো হল। কোন কাজটি ছেড়ে কোন কাজটি করবে, ভেবে পাচ্ছিল না নিবারণ। যদিও একজন পাকা বাদকের মতো নিবারণ সেরে ফেলছিল কাজগুলি। কত কিছু করছিল, ভেবে ভেবে কাজ খুঁজে বার করছিল। উঠোনে উনুনের পেটে কাঠকুটো ভরে দিল, দাউ দাউ আগুন লক লক করে উঠল, দিগম্বর দেখছিল, প্রতিদিনের কাজের নিপুণ মানচিত্র এঁকে চলেছে নিবারণ। বড়ই মায়া আছে বাড়ির কোঠা ও উঠোন জুড়ে। দিগম্বর দেখতে দেখতে সমস্ত চৌকাঠ পার হয়ে, কল্পনার একটি নৌকো গড়ে তুলছিল।

এই অবেলায়, কি নিপুণ হাতে সব সেরে নিলে দাদা। কত যত্ন আত্তিতে রান্না করে খাওয়ালে। তোমার রান্নার স্বাদে এখন আরব এসেছে দাদা।

সে আমার ভাগ্যি দিগম্বর। আরও কিছু বলার ইচ্ছা করো দিগম্বর।

গাছ, নদী, জলাশয়, বৃষ্টি, ফসল এইসবের ব্যাখ্যা কি ?

গান্ধারি, সত্যবতী, কুন্তি, দ্রৌপদী, বেহুলা...

আমার মনের কথাটি কি করে বুঝলে ?

সৃষ্টি, সত্য আর গর্ভধারণ।

একবার কি সৌভাগ্য হবে না দাদা ? 

নিবারণ কিছু বলতে যাবে আরও, জিভের ডগায় আটকে এল অনেক কথাপাখির পালকের মতো আদুরে হয়েছে দিগম্বরকে দেখতে। হবে না ? কৃষকের সন্তান। লাঙ্গলবিদ্যা জানা পরিবারের অনুজ। সাতসমুদ্র অসংখ্য নদী পাহাড় পর্বত অনেক দেশের পরে এই দেশে এক সাহেবের খেয়ালের দোসর। পরিবারের অহংকার দিগম্বর। নিবারণের হাতে তালপাখাটি ছন্দে ছন্দে নড়ছিল। দিগম্বরের শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছিল। 

কজনের অনুজ সাহেবের খেয়ালের দোসর হয় ? পারবাসুদেবপুরে দিগম্বরই একজন। নিবারণের গর্বে অহংকার ফুলে ওঠে। বহু বছর পরে যে নক্ষত্র পারবাসুদেবপুরে আকাশে মিটি মিটি করে জ্বলবে, সে জানবে না নিবারণ ও দিগম্বরের সখ্যের কথা। জানবে না তাদের রক্তের সম্পর্কের কথা, - কোনোদিন যদি, পেচক অন্য পাখিতে রূপান্তরিত হয়, সেও জানবে না নিবারণ ও দিগম্বরের কথা। এই সময়ে চমৎকার অপরাহ্ণ, কত না বিস্ময়কর চমৎকার সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

তোমার তালপাতার বাতাস না নিলে কীসের গ্রীস্ম দাদা। সাহেবের কাছারিখানাতে হাঁসফাঁস করি। তোমার বাতাসের স্পর্শের জন্য। দাওআমাকে পাখা দাও। আমিও তোমাকে একটি বাতাস করে দিই।

আমি তো আমার স্থানেই আছি। তুমি কতদিন পরে এলে।

মহাকব্যের নারী পুরুষের চরিত্রে কোনো ভেদাভেদ থাকে ?

চরিত্রটাই বড়ো দিগম্বর। স্নেহতে যদি এত জাদু, তা হলে তাতে এত হিংসা ও ব্যঘাত কেন ? 

আমার সঙ্গে একই পাতে তুমি সেরে নিতে পারতে ? নদীতে এখন পূর্ণ জোয়ার। কতবছর এক পাতে খাইনি। অনেক দেরি হয়ে গেল তোমার ? 

তোমার আহার শেষ না হলে, আমি কি করে গরস নিই ? আরেকটা গলসে দিই পাতে ?  

কত গলসে এসেছে ঝিল বিলে।  

বড় জলাশয়ের মাছ। নদীর জোয়ার ভালোবাসে নাশুকনা দিয়ে গেল। বেচারি। নাড়িকুড়ি গ্রামের পাখুয়াদের সঙ্গে কি ঝামেলা হল ওর স্বামী সতু মান্নারটাঙ্গির কোপ বসিয়ে দিল নাড়িকুড়ির একজন সতুর ঘাড়েবাঁচল না। বসাকদের বাড়িতে সালিসি সভা বসল। কিন্তু ওরা পাখুয়াদের পক্ষ নিল। ওদের অপরাধ গণ্য হল না।   নিরপরাধ হিসেবে মান্য পেল। সতু বেচারারদের দল প্রাণ বিসর্জন দিয়ে চিরকাল শয়তান ক্ষমতাবানদের দুইয়ে গেল। শুকনা এখন অসহায়। আমি এক ধামা চাউল দিলাম। খুশি হয়ে নিয়ে গেল। বেচারিদেখলে কষ্ট হয়। মাঠে মাঠে কাজ করে দিন আতিপাতি করত সতু। এখন শুকনা বিল ঝিল জলাশয়ের মাছ ধরে কুড়িয়ে বেড়ায়।  

কেন ? শুকনার আর কেউ নাই।

বাঃ। ভুলে গেলে ? গত বৈশাখে তোমায় দেখলাম না ? সতু বে করে ফিরল কালবৈশাখীর বিকেলে। তিনদিনের বৃষ্টিতে তল্লাট কেমন জলডুব হয়ে গেল। ওরা ভাঙ্গা জলের আয়না ডিঙ্গিয়ে পারবাসুদেবপুরে ফিরল। তুমি তা দেখে কি বলেছিলে মনে পড়ছে না ?

হ্যাঁ। এবারও বলছি, বে করে নাও দাদা।

সে কথা আর বলো না। মনের ইচ্ছার সঙ্গে বিবাহের একটা সম্পর্ক থাকে। সেই ইচ্ছাটাই যখন আর নাই, তখন সে কথা বলে আমাকে আর বিব্রত কোরো না।

চাউল দিয়ে ভালো করলে। শুকনাকে হাতের কাজের জন্য একবার বলে দেখ না। যদি করে, তা হলে তোমার সাহায্য হয়। তোমার কাজের বোঝা একটু হালকা হয়।

দেখ আমি এখানে একা থাকি। একজন কামলা হলে, চলে। কিন্তু স্বামী মরা মহিলাগ্রামবাসীরা কত কথা বলবে, মানুষের মনে সন্দেহ বা ধারণার জন্ম দিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে অনেক দোলাচল থাকে। এই তো ভালো আছি। তুমি আছো। আমি আছি। এই বা কম কিসের ? আমার কথাটি একবার বোঝার চেষ্টা করো দিগম্বর। 

তোমার কথা চেষ্টা করে বুঝেছি দাদা এখন সময় ও শরীর তোমার পক্ষে আছে। আগামীদিনে থাকবে না। এই চাষবাস ফসল লাঙ্গল মই আগড় কার জন্য। গোয়ালমন্দির ? এখানে একা মানুষ তুমি, আমার ঠিকানা বাঁধা আছে সাহেবের কাছারিখানায়। আমি তার খেয়ালের দাস। তোমার জন্য ভাবনা হয়। তুমি অনুমতি দিলে ভাস্কর পণ্ডিতের সঙ্গে একবার কথা বলে যাই ?  

এই অবেলায় তোমার এই সব কথা বেমানান লাগছে দিগম্বর।

কিন্তু সময় যে বড়ই বিস্ময়কর। বহুরূপীর মতো। 

একাকার করে সন্ধান চালাচ্ছি চারধার। কিন্তু কোনোই ফল হচ্ছে না। মনে হচ্ছে তাকে ভুষোকালি মাঠের ক্ষ্যাপা পেয়েছে ? নিতাইনন্দনের বাগানে সজনে গাছের ডালে থাকছে সে হয় তো। আবার বিলখালির মাঠে অশ্বত্থের মাথায় আবার দেঁতের খালের পাশে পশুশ্মশানে শকুনের পাশে বসে আছে। হয় তো আমার বিভ্রম, আমার যুক্তিহীন পাগলামি। সে তল্লাটের বায়ুর সঙ্গে সখ্য করে। এ তুমি বুঝবে না, এ এক অনুসরণের বিভ্রম   

আহার শেষে দিগম্বর কাঁসার পালি মুখের কাছে নিয়ে নিজের কথাকেই খণ্ডিত করে, বলল,-- ও যে ......

কিছুই নেই তবুও কিছু করার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তুমি তো পিতৃদেবের রচনা পড়েছ।

আদ্যোপান্ত। 

তুমি সৌভাগ্যবান। আহা !! নিজের জীবনের রচনাকার তিনি নিজেই।

আমরা দুইজনেই পিতৃদেবের কল্পনাকে বহন করে চলেছি। এমন কি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সময় পিতৃদেবের রচনার অংশীদার। পুঁথির প্রথম দিকেই তিনি রচনা করলেন,-- “দুধ আম ননী ঘি ছানা খেলে উদরে আরাম বোধ হয়। জিহ্বা তৃপ্তি বোধ করে। আমার সন্তান পৃথবীতে এলে তারা এইসব স্বাদ গ্রহণের জন্য পরবাসে যাবে না। এইখানেই সেই সব গ্রহণের ব্যবস্থা আমি নিজেই করে যাব।”

হ্যাঁ, পিতৃদেব তাঁর রচনার প্রথমদিকে বৈষয়িক মনোভাবের তীব্র প্রকাশ করেছেন। আর চাষবাসের উন্নতির কথা নিরন্তর ভেবেছেন। কিন্তু পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে নিজের বিলীন হয়ে যাওয়ার রহস্যটি নাই বা বলতে পারতেন। লিখতে লিখতে যদি তিনি নিজেকে নির্মাণ করে যান, তা হলে তাঁর কল্পনার নাগাল পাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা তাঁর সন্তান। স্মৃতিতে স্মরণে তাঁকে অনুসরণ না করলে চলে না। আমরা তা করি নি। আমাদের না জানা ও পিতৃদেবের জানার বিষয়গুলি আমাকে গভীর আনন্দ দেয়মঙ্গলকাব্য অধ্যয়নের মতো।

তা হলে তুমি অনেকটাই পড়ে ফেলেছ।

আমরা দুইজনেই পিতৃদেবের লেখা পুঁথির অধ্যয়ন করেছি।

তুমি পাতিহালে গেলে ভাগ্যিস ?

আমাকে সেই যন্ত্রণা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।

পাতিহালের বিষয়টি তুমি জেনে নাও, কথাটি বলেই,- দিগম্বর তক্তপোষ থেকে নেমে বোচকা থেকে, একটি হলুদ রঙয়ের রেশমের চাদর নিবারণের সামনে মেলে ধরে তার কোলের ওপরে বিছিয়ে দিয়ে বলল,-- বাগুয়ার তাঁতিদের ঘর থেকে আনিয়ে রেখেছিলাম। নিমপাতা দিয়ে পিতৃদেবের পাণ্ডুলিপি মুড়িয়ে রেখ। পোকায় কাটবে না। উইপোকাও ধরবে না।

কিন্তু দিগম্বর...

আমি সাহেবের কাছারিখানায় ফিরে গেলে পাঠ সম্পন্ন করে নাও। তুমি না পড়লে পিতৃদেবের সমস্ত প্রচেষ্টাই বিফলে যাবে। তিনি এক বিস্ময়কর চরিত্র। পারবাসুদেবপুরে থেকেও তিনি ছিলেন গ্যারিবল্ডির মতো। তাঁর লেখায় শ্রেষ্ঠ চরিত্র তুমিই। তিনি যা করতে পারেন নি, সেই না করতে পারা কাজগুলিই তোমার মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করে গেছেন। গ্রন্থ প্রণেতারও নিজের লেখাতেও একপ্রকার দুর্বলতা থাকে। সেই দুর্বলতা তিনি নিজেরই কল্পনায় গড়ে তোলা চরিত্রের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করেন। পিতৃদেবও তাই করেছিলেন, তোমার মধ্য দিয়েই তা ব্যক্ত করেছেন। 

হ্যাঁ দিগম্বর। আমরা সবাই কল্পনার মধ্য দিয়েই তো গড়ে উঠেছি।

তুমি চাষকর্ম কৃষি সরঞ্জাম তৈয়ারে জ্ঞানিসব জমির লাঙ্গল একরকম হয় না। তুমি তা জানোপিতৃদেব তাঁর লাঙ্গলবিদ্যার জ্ঞান তোমার মধ্য দিয়েই প্রকাশ করেছেন।

নিবারণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সেটি যেন সব হারানোর শ্বাস। কি অনর্থ ঘটে গেছে, দিগম্বর তা জানে না। প্রকাশযোগ্য না হলেও এই কঠিন সত্যকে কি করে সে আড়াল করে রাখবে। বলতে তাকে হবেই। না বললে, সে একটি মিথ্যের সাথে বসবাস করবে। নিবারণের কোলের ওপরে হলুদ রেশমের কাপড়। পিতৃদেবের পাণ্ডুলিপির জন্য সে এনেছে।

কি যায় অমন বিকট শব্দ তুলে ?

কৃষি সরঞ্জাম নিয়ে যাচ্ছে পশুযান। এই শব্দে গর্ভবতী সজারু ভয় পায়। ওজন কিছু গড়িয়ে গেলে পশুকুল ও প্রাণিজগৎ ভয় পায় দিগম্বর।

চমৎকার তোমার প্রকৃতিপাঠ।

তুমি সেগুন গাছের চারা নিয়ে এলে।

তোমাকে বললাম, বেইলি সাহেব দিলেন।

কোনস্থানে পুঁতব ?

বণিক দিঘির দক্ষিণ কোণের দিকে 

কালবৈশাখী চিহ্ন রেখে রেখে গেছে। পোড়া একটুকরো জমি ক্ষতের চিহ্ন আছে।

লক্ষ করেছ দিঘি জলাশয় পুকুর ঝিল খালের জল এত কালো কেন চারধারে ?

জলে এবার কৃষ্ণ এসেছে।

জল কালো মেঘ পেয়েছে। মেঘ আসে মেঘ যায়। এই যে যাওয়া এরও একটা অর্থ আছে।

তাই লিখেছেন পিতৃদেব। অনুসরণ...অনুসরণ...  

দিগম্বরের হাত থেকে পিতলের পালিটি নিয়ে নিবারণ মাটিতে ফেলে দিল। তারপরে আর্তনাদ নয়, চিৎকার নয়, নয় কোনো প্রলাপ...গুমরে ওঠা কান্না...আমাকে ক্ষমা করো...আমাকে ক্ষমা করো... ক্ষমা করো দিগম্বর। ভীষণ ভীষণ অনর্থ ঘটে গেছে। আমার উদাসীনতা ও অবহেলার জন্য এই অনর্থ ঘটে গেছে। আমি তাকে খেয়ালে নজরে রাখতে পারি নাই।

সে কি !!! কীসের অবহেলা ? কীসের উদাসীনতা ?

আমাকে বলতে দাও দিগম্বর। তোমাকে এই কথা না জানালে খুব অন্যায় হবে। বলব বলব করে আর পারছিনে। কিন্তু বলতে না পারলে একটি গভীর সত্য আড়ালে থেকে যাবে। সে বড়ই অনর্থ হবে।

কীসের অনর্থ ? তুমি এ কি বলছ ?

আমাকে বলতে দাও দিগম্বর।

তুমি এখন বিশ্রাম নাও। আমি বুঝতে পারছি তুমি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছ। এখনই তোমাকে সত্য কথা বলতেই হবে ? কতদিন পরে আমি এলাম তোমার কাছে। একটু না হয় আমোদ করি। তারপরে বিশ্রাম নিয়ে না হয় বলো।

গাছের ডালে দুই একটি মাটিরূপে পুতুল পাখি। দুপুরের শিয়াল ডেকে ডেকে চলে গেল দেঁতের খালের দিকে। সন্ধ্যামালতী পাপড়ি খুলবে বলে নিথর আধবোঝা। দিনের শেষে যে আলো গাঢ় ধূসরের দিকে সরে যাচ্ছিল, সেই আলো জেনে গেছে, কিছু ঘটবে বলে স্তম্ভিত। 

ম্রিয়মাণ আলোকে কে যেন বলল,-- দাঁড়াও !!!

কেন তুমি দুঃখ করছ দাদা ? পিতৃদেব যে অনুসরণের কথা লিখে গেছিলেন তার বিনাশ হয় না। বিনাশ হয় না বলেই মানুষের কাজ থেমে থাকে না। প্রতিদিন আমরা যা করে চলেছি তা মহাজগতের অনুসরণ মাত্র। পিতৃদেব যে অনুসরণের কথা লিখে রেখে গেছিলেন তা – অনুসরণ মাত্র। এই চরাচর, জলাশয়ে সুস্বাদু গলসের আনাগোনা, চাষের যন্ত্রপাতি, ফল পেকে মাটিতে পরে গড়াগড়ি দেয়, এই সবকিছুর মতোই অনুসরণ হল এক সত্য অভ্যাস। তুমি লাঙ্গল বানাবে, পিতৃদেব গাছের ডালে উড়ে গিয়ে বিশ্রাম নেবে, মহাশূন্যের জামা পড়ে তিনি বাতাসে ভেসে এসে কখনও কখনও আমাদের সখ্য অর্জন করবেন, আমি মানচিত্র নক্সার কাজ করব – এইগুলি নানান কাজের অনুসরণের একমাত্র কাজ।

নিবারণ প্রায় ভেঙ্গে পড়া গলায় বলল,-- আমাকে অনুসরণ করতে বলে তিনি নাড়িকুড়ির গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলেন। তিনি মৃত এই কথা ভাবতে আমার কষ্ট হয়। আমিও তাই তাঁকে অনুসরণ করেছিলাম, ভেবেছিলাম, তিনি আমাকে সবসময় অনুসরণ করতে বলেন।  

জীবিতকালীন সময়ে পিতৃদেবকে আমরা নানা ভাবে দেখতে পাব। তুমি যখন লাঙ্গল তৈয়ারি করবে সেই সময় আমি যখন মানচিত্র নক্সার কাজ করব সেই সময়। তিনি মৃত এই কথা সত্য হলেও, এর গভীরতর অভ্যন্তরে অন্য আরেক সত্য লুকিয়ে আছে। যার কোনো ব্যাখ্যা নাই। এই বিশ্বসংসারে যার জন্ম হয় তার মৃত্যু হয় না। শরীরের বিনাশ হলেও স্মৃতিতে তিনি থেকে যান। এই স্মৃতিই কখনও কখনও জীবন্ত হয়ে ওঠে।

কিন্তু আমি তাঁকে দেখেছি।

কি ভাবে দেখেছ ? কেমনতর ? 

শরীর ছিল না তাঁর। ছিল তাঁর খড়ম পা দুইটি। বেশ উচ্চতায় ভেসে যাচ্ছে। মেঘ জড়িয়ে গেছে পায়ে। আর তার কণ্ঠস্বর প্রবল। 

কেমনতর দিন ছিল সেদিন ?

এখন যেই লাঙ্গলটি আমি তৈয়ার করছি, জানালা দিয়ে একবার তাকিয়ে দেখ, মাটির দেওয়ালে ঠেস দেওয়া আছে। আমাকে তিনি মৃত্যুর আগে বলে গেছিলেন কোথায় বাবলা গাছটি আছে। সেই গাছের কাঠ দিয়ে লাঙ্গল বানাতে হবে। এমন এমন দিন আসে সহজে আমরা ভুলে যেতে পারি নাসেইদিনের সেই সকাল মেটে রঙ ধরেছিল। মহাপৃথবীর সেই একাকী নির্জন সকালে আমি আর অবলা বাবলা বৃক্ষ। পরের পর কুড়ুলের আঘাতে জর্জর করে বাবলা গাছের গোঁড়াকে উচ্ছেদ করে তার শাখা প্রশাখাকে খণ্ডিত করলাম। দুই বলদের যানে বৃক্ষের খণ্ডাংশ নিয়ে এলাম। 

দিগম্বর বলল,-- একটু শুকনো আমলকী থাকলে দাও।

নবদ্বীপ থেকে ভালো দোক্তাপাতা আনিয়েছিলাম। নেবে ?

নবদ্বীপের দোক্তাপাতা ভালো তোমায় কে বললে ?

রসুল।

রসুল ?

জসীমচাচার ছেলে।

কেমন আছেন জসীমচাচা ?

ফতুল্লাপুরের কবরখানার মাটির নিচে ঘুমোচ্ছেন ?

সে কি ? জসীমচাচার এন্তেকাল হয়ে গেল ?

হ্যাঁ। তাই হল। 

রসুল একাই কফনের ব্যবস্থা করল ?   

আমি বললাম, থাক আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সারারাত জেগে জসীমচাচার কফন বানালাম। এই পুণ্য কাজের অবসর কেউ ছাড়ে ? একটা মানুষ ঘুমোবে তার ব্যবস্থা করে দেওয়ায় অনেক শান্তি দিগম্বর। এই পৌষের শেষে তোমার মনে পড়ছে বরফকুচি ঝড়ে পড়লখুব কষ্ট পেল। বিচালির ভিতরে ঘুমোত। ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারল না। বিষপোকা না গোখরো, দয়াবান জসীমচাচাকে কৃপা করল। রসুল এখন সিংহদরজা, পালকি, ফিটন, বায়ুকপাট, তানপুরা, তবলা বাদ্যযন্ত্র, হুঁকো নানান এই সবকিছু মোছামুছির কাজ করে। হেমেন্দ্রকুমার দেওয়ান ওকে খুব স্নেহ করে। আমার সঙ্গে একদিন সেনের আড়ার হাটে দেখা হয়েছিল। কাছে ডেকে বসালাম। খুব খুশি হল। আর এমন তাকাল আমার দিকে, খুব ক্ষিদে পেয়েছিল। বললাম, হাটবারে তোমাকে এখন আর দেখা যায় না কেন ? বলল,-- গুঁড় বিচালি আর মাটির সরা কিনতে এলাম।

বিচালি তো দেখলাম না রে ?

নাককাটা মায়ের দুয়ারে পাশে এয়েচে একজন। নিবারণকা ফিঙ্গে উদিকে না ? 

জিজ্ঞেস করে নে একবার। তবে নিমতের ওইদিক দিয়ে যেতে হবে। নিমতের কয়েকজনকে দেখলাম মনে হল। সোনাই নদীর স্মৃতি পড়ে আছে। পাশ কাটিয়ে চলে যা একবার।

সোনাই নদী !!!

মধ্যযুগের চিহ্ন দিগম্বর।

নিবারণ রসুলকে নিস্পলক দেখছিল। দেওয়ান বাড়ির কাজের লোক এখন সে। বাইরে এলে কেমন কুটুম কুটুম লাগে দেখতে। সেনের আড়ার হাট ঘুমিয়ে এলে চারধারে কেমন এক ঘুমিয়ে পড়া পুঁথির প্রায়শ্চিত্ত হয় যেন।  (ক্রমশঃ)       

 

17 comments:

  1. এমন মহৎ লেখা পড়তে পারাই আমার সৌভাগ্য। ধন্যবাদ দাদা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. শতানীক ভালোবাসা...

      Delete
  2. অসম্ভব সুন্দর চরিত্র বুনন! এমন লেখায় আমাদের গ্রাম্য মাধুর্য ফুটে উঠছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. তুমি তো নিয়মিত পড়ছ... অনেক স্নেহ

      Delete
    2. তুমি তো নিয়মিত পড়ছ... অনেক স্নেহ

      Delete
  3. পড়লাম দাদা। অপূর্ব লাগলো 💐💐

    ReplyDelete
    Replies
    1. নিয়মিত পড়ছেন জেনে ভালো লাগছে.. অনেক অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
    2. নিয়মিত পড়ছেন জেনে ভালো লাগছে.. অনেক অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  4. শুভংকর গুহর যেকোনো লেখাই পড়তে পাওয়া একটা সৌভাগ্য। তাঁর গদ্যটা এমনই যে, তাকে সরিয়ে উঠে যাওয়া যায় না।
    কুর্নিশ শুভংকর দা।

    ReplyDelete
  5. রণজিৎ তোমার মন্তব্য এবং অভিমত সমৃদ্ধ করে। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  6. রণজিৎ তোমার মন্তব্য এবং অভিমত সমৃদ্ধ করে। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  7. রণজিৎ তোমার মন্তব্য এবং অভিমত সমৃদ্ধ করে। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  8. একটা মায়া। কুহক।ঘোর।আর সাথে তীব্র এক গ্রামীণ জীবনের ছবি। নিশ্চিত বিভ্রম। অনবদ্য।

    ReplyDelete
  9. আরেকটা মজবুত লেখা...স্মৃতির ভীতে চুন সুরকির গাঁথনি...ইমারতের অপেক্ষায়।

    ReplyDelete