বাক্‌ ১৪৫ ।। জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

ভীতু বাঘের পাঁজর


“...
ওই ক্লাস এইট-ফেইট থেকেই পাঁচিলে বসার নেশাটা ধরে গেছিল... বুঝলি? যেদিক দিয়ে মেয়েরা স্কুল থেকে ফেরে, কোচিং-এ যায়... সেদিকের রাস্তায় গ্যালারির মতো একটা পাঁচিল! টোন-টিটকিরি করতাম না, ওসব ট্রাই করলে কাকা-জ্যাঠারা চামড়া গুটিয়ে দিত। আমাদের চেয়ে অনেক বড় ছেলে, সিটি মেরেছিল বলে ঘর থেকে বার করে চাবকেছিল! ওই নিজেদের মধ্যে হালকা ফাজলামি চলত। টুকটাক কথা পথচলতি মেয়েদের কানে গেলে... কেউ মাথা নীচু করে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এগিয়ে যেত... কেউ মুখে হাত বা রুমাল চাপা দিয়ে হাসি লুকোনোর চেষ্টা করত। এক-একটা মেয়ে তো আমাদেরই দেখে নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে হাসাহাসি করত! কোনো কোনোদিন, যেতে যেতে হঠাৎ কেউ ফিরে তাকাত, আমাদেরই কাউকে দেখে হালকা হাসত। চেনা-অচেনা যে-ই হোক... এই ফিরে তাকানো, অল্প হাসি... যেন সেদিনের প্রাইজ!”

—দেবাদা, তুমি বসে বসে এভাবে ঝাড়ি মারতে?

—সালা বাচ্চা-বাচ্চা মেয়েদের ঝাড়ি মারার গল্প বলছ এখন রসিয়ে রসিয়ে... কী নির্লজ্জ মাইরি!

বাচ্চা-বাচ্চা মেয়েদের মানে? মাইনর অ্যাবিউজ? ঝান্ডু বামের মতো কথা বলছিস কেন? আমাদেরই তো তখন ষোলো বছর বয়স হয়নি! কিসুই বুঝবি না, কিসুই জানবি না... আর...”

—আরে দেবাদা-ই তো তখন কচি!... সিনেমায় দেখিস না স্কুলের বাচ্চা ছেলে স্কুলের বাচ্চা মেয়েকে কার্ড-ফার্ড দিয়ে প্রোপোজ করে? তোর ছোটবেলা কোনো চাপ ছিল না? থাকবে কী করে... ক্লাস সেভেন থেকেই তো...

যাক গে... ওকে কাটা। যেটা ভাবছিলাম ভুলে যাব।

—হ্যাঁ হ্যাঁ... বলো... তারপর? কোনো মামণির বাপ-কাকার কাছে উদমা ক্যাল খেলে?

না না... ক্যাল খাওয়ার মতো কিছু করার ধকই ছিল না। নিজেদের মধ্যেই একটা খেলা ছিল— আমাদের মধ্যেই এক-একজনকে ধরে নিতাম, ওই পথচলতি মেয়েদের কারও দোসর বলে। মানে ওই ভারচুয়াল পার্টনার... বুঝলি তো? আর সেই মেয়েটি সেদিন সামনে দিয়ে গেলে অথবা তার প্রসঙ্গে কথা উঠলে সেই ছেলেটির নাজেহাল অবস্থা করা হত!”

—তোমারটার কী নাম ছিল?

—কী নাম ছিল--!... মদন!... নাম বললে চিনবি?

—আরে জাস্ট এমনিই...

‘‘হ্যাঁ... এইরকম 'এমনি'-ই একটি মেয়েকে নিয়ে এক বন্ধুকে হেবি খ্যাপানো হত। সে প্রচণ্ড রেগে যেত, আবার রাগের মধ্যেই হেসে ফেলত... ব্লাশ করে ফেলত। আর হাসলেই তুমুল চাট। নাম কেমন, দেখতে কেমন... কী ছিঁড়বি জেনে? একটা আলগা শ্রী ছিল, আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের থেকে খুব একটা আলাদা কিছু না। ফালতু টাইম-পাশ... অথচ, হঠাৎ এক সময়ে ফিল করলাম— ওই মেয়েটিকে নিয়ে কাউকে ক্ষ্যাপানো হলে আমার কেমন বিরক্ত লাগছে... রাগ হচ্ছে! মনে হত— ওকে কেন ক্ষ্যাপাচ্ছে? ওই মেয়েটাকে নিয়ে আমাকেও তো বলতে পারে?’’

—পাপী মন... পাপী মন দেবাদা!... পাপী মন!

বলতে পারিস... পাপী মন। সাবকনশাসটা ঠেলে বেরিয়ে এল। চ্যাংড়াগুলোকে কাটিয়ে, নিজের সাইকেলকে ভরসা করে এদিক-সেদিক থেকে ওর ব্যাপারে ইনফরমেশন জোগাড় করলাম— মেয়েটা আমাদেরই পাড়ার কাছাকাছি একজনের কাছে বাংলা পড়তে আসত... প্রতি শনিবার।

ক্লাস নাইনের মাঝামাঝি হঠাৎ আমার ‘বাংলার জন্য গাইডেন্স লাগবে’ শুনে বাড়ির সকলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বাবা খুব চেষ্টা করেছিল ব্যাপারটা দমিয়ে দেওয়ার... ‘কিছু না বুঝলে আমাকে জিজ্ঞেস কর... আমি তো আছি’, ‘স্কুলের হরিপদবাবুর থেকে গাইডেন্স নে’কিন্তু আমি সেই একভাবে ঢ্যাঁটার মতো ঘ্যানঘ্যানটা চালিয়েই গেলাম— নম্বর কমে যাবে ফাইনালে, সায়েন্স গ্রুপকে টাইম দিতে পারছি না... ভয় লাগছে। মাঠে-ঘাটে চড়া বলদ... পড়ার জন্য হাতে-পায়ে ধরছে... আমার বাপ আর রিস্ক নিল না, রাজি হয়ে গেল! ফুর্তিতে শান্তি ময়রার দোকান থেকে গোটা দশেক সরভাজা সাঁটিয়েছিলাম সেদিন।

—চাপ বিষ জিনিস ভাই... কত কী যে করিয়ে নেয় মানুষকে দিয়ে!

—হুম... পরে নিজেকে চু লাগে... কিন্তু সেই সময়ে আলাদাই জোশ! যেমন দেবাদার ছিল...

হ্যাঁ, বিলা আনন্দ হয়েছিল, জীবনে প্রথম বাবাকে এইভাবে কনভিন্স করলাম... তাও ওর জন্য! কিন্তু কোচিং-এ গিয়েই বাঁশ খেয়ে গেলাম... প্রথম দিন গিয়েই দেখি ব্যাচে চার-পাঁচটা মেয়ে! স্যার ছাড়া কারও দিকে তাকাতে চাপ লাগত। জেলার বয়েজ হাইস্কুলের মাল... কোনো এক্সপিরিয়েন্স নেই... পুরো গুটিয়ে যেতাম। যার জন্য যাওয়া... সে চোখের সামনে বসলেও তার দিকে ডিরেক্টলি তাকাতে পারতাম না।

—এহ, এত মাথা খাটিয়ে কোচিং-এ ঢুকে পুরো এক হাত...

না না... উলটো কেস হল। পড়া-ফড়া পেরে যেতাম বলে কোচিং-এর অন্য ছেলে-মেয়েগুলোর মাঝে ভাও বেড়ে গেল। বাংলা ছাড়াও অঙ্ক, ভৌত-বিজ্ঞান এসব নিয়ে জিজ্ঞেস করত। উইক স্টুডেন্ট সব... বুঝলি তো?”

—মানে... এই তোর-আমার মতো। সেকন্ড ডিভিশন।

‘‘ওরা স্যারের সামনে একেবারে সিঁটিয়ে থাকত... ওই খিটখিটে লোকটাকে দ্বিতীয়বার কিছু জিজ্ঞেস করারও সাহস পেত না, পরে আমাকে জিজ্ঞেস করত। আর আমিও এগুলো বেশ এনজয় করতাম! ফরচুনেটলি, ওই মেয়েটাও খুব উইক ছিল বাংলাতে... মুখস্থও করতে পারত না। কারক-সমাস... ধরলে কেঁদে ফেলার জোগাড়। স্যার বলতেন ‘পড়াশুনায় নাই মন... ভবিষ্যৎ বৃন্দাবন’! সে বকুনি খাবে, আর অন্যেরা হিহি করে হাসবে... রোজ এসব দেখতে ভালো লাগে? বল? গায়ে পড়েই ওকে হেল্প করতাম... যাতে এমন হিউমিলিয়েটেড না হয়। সেই মেয়েটিও আমার থেকে এটা-সেটা টুকে নিত। এই যে দুটো কথা বলছে, হাসছে... আমার দিকে তাকাচ্ছে... এটাই তখন সব! এতদিনে মনে হত কিছু কাজ দিল কোচিং-এ ঢুকে।

—হিউমি?

—হাসির খোরাক... খোরাক না হয়।

—অ।

“...কিন্তু আমার বাড়ি তো কাছেই, আর মেয়েটা বাকি বান্ধবীদের সাথে উলটোদিকের রাস্তায় চলে যেত। কোচিং-এর বাইরে ভাব জমানোর চান্স পাচ্ছিলাম না। তারপর জানলাম— ওর ইংরেজির মাস্টারের বাড়িটা আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূর, আর ওদের বাড়ির দিক দিয়েই যেতে হয়। ব্যস, আবার বাড়িতে ডিম্যান্ড উঠল— ইংরেজির জন্য চাপ পড়ছে... রিস্ক হয়ে যাবে! একটা প্রপার গাইডেন্স দরকার! হাফ ইয়ারলিতে রেজাল্ট ভালো হয়েছিল, ওটা কোচিং-এর কৃতিত্ব বলে ইংরেজি টিউশনেরও ব্যবস্থা পাকা করে ফেললাম।

—বিষ তো পুরো!

—তুমি একদম জিনিস সুবিধের নও দেবাদা...

আরে আমাদের পাঁচিলের আড্ডাটাই মাঝখান থেকে চপে চলে গেল! নিজের পড়ার বাইরে সময় বের করে ওর জন্য নোট বানিয়ে রাখাটাই একটা বাড়তি চাপ! তারপর একসাথে ইংলিশ টিউশন থেকে ফেরা, একটু সাইকেলে এখানে-সেখানে... ”

—ওই বয়সে পার্ক-ফার্কেও যেতে? ঝোপঝাড়?

—কী সব বার করছ গুরু!... মানে তুমি! দেবাদা তুমি!

না না... একটু সাইকেল নিয়ে এরিয়ার বাইরে পাক খেয়ে আসতাম। কথা আর কী... ওই ঘুরেফিরে সিনেমা, গান, স্কুলের আলফাল কেস, এই দিদি, ওই দাদা... এইসব। আর ওই জমানো হাতখরচার টাকায় আলুকাবলি, ফুচকা, আইসক্রিম... আমারই পেছনটা ফাটত আর-কি! বলতে হয়তো অনেককিছুই চাইতাম, ইচ্ছে হত... কিন্তু পারিনি। মানে ওই... সেও বুঝছে, আমিও বুঝছি... বাড়তি কথায় কাজ কী? খুব সাবধানে থাকতে হত, মাঝেমাঝে ইচ্ছে করেই কোনো কমনফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরতাম... যাতে কেউ ডাউট না করে, বাড়িতে এসব নিউজ না ঢোকে। তাও সালা শেষরক্ষা হল না... পুরো ব্লাইন্ড সাইড থেকে ঝাড়টা খেয়ে গেলাম!”

—ব্লাইন্ড সাইড বোলে তো? সেম সাইড? অফ সাইড?

—এই রে! বেশ কুছ কুছ হোতা হ্যায় চলছিল... মেয়েটার বাড়ির কেউ দেখে ফেলে মার-ফার লাগিয়ে দিল?

আরও বিষাক্ত কেস! ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক আগে, ইংলিশ কোচিংক্লাসে সাজেশনগুলো ঝালিয়ে নেওয়া চলছে। হঠাৎ একটা রোগা-লম্বা ছেলে কোচিংক্লাসের দরজার সামনে এসে স্যারকে বলল ‘স্যার... দেবার্ঘ্যর বাবা পাঠিয়েছে, এখনই বাড়ি ফিরতে হবে ওকে’ মালটাকে জীবনে দেখিনি। আমাদের পাড়ার ছেলেই না। কিন্তু বাবার নাম করে বাড়ি ফিরতে বলছে শুনে টেনশন হয়ে গেল... সে সময়ে তো মোবাইল ফোন-টোন কিছু ছিল না। স্যার কারণ জিজ্ঞেস করেছিল, ছেলেটা বলল ঘরে কিছু হয়েছে হয়তো... ও শিওর না। ‘ঘরে কিছু হয়েছে’ শুনে চাপ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ছেলেটা একটা বাইকে উঠে আমাকে পেছনে বসতে বলল। আমি জানতে চাইলাম বাবা কেন ডেকেছে... কী হয়েছে বাড়িতে? ছেলেটা বাইকে স্টার্ট দিয়ে বলল— ‘যাচ্ছি তো, গিয়েই জিজ্ঞেস করিস... নে উঠে পড়’। আমি পেছনের সিটে বসতে বসতে বললাম— ‘তুমি বাবাকে চেনো? ছেলেটা কোনও উত্তর দিল না। ছেলেটা আমার থেকে বয়সে বড়, ওই কুড়ি-একুশ হবে। স্পিডে বাইকটা টেনে বেরিয়ে গেল ওই এরিয়া থেকে। কিছুদূর গিয়েই টের পেলাম যে আমার বাড়ির দিকে মোটেই যাচ্ছে না!”

—কেলো করেছে! কী হয়েছে কনফার্ম না করেই চলে গেলে? কেউ করে?

—এটা মেয়েটারই কেউ হয়... শিওর... তোমাকে জানায়নি মেয়েটা... বানিয়েছে তোমাকে পুরো!

কেন যে ওভাবে আননোন ছেলের কথায় বেরিয়ে এলাম! আসলে ওটা কোনো না কোনোদিন হবারই ছিল। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা, রানিং বাইক থেকে লাফ দেওয়ার রিস্কও নিতে পারলাম না। চেঁচাতেও পারলাম না... গলা-ফলা শুকিয়ে গেছে... বাইক থামানোর জন্য হাতে-পায়ে ধরছি। কেন, কী ব্যাপার— এসব কিচ্ছু জানার ইন্টারেস্ট নেই তখন। লাস্টে একটা শুনসান এরিয়া দেখে, একটা গাছের পাশে বাইকটা দাঁড় করাল। তারপর বাইক থেকে নামতেই খপ করে আমার হাতটা ধরে নিল। ওই রোগা চেহারার ছেলেটার কবজিতে যে কী সাংঘাতিক জোর, তা হাত ধরতেই টের পেলাম। আমাকে টানতে টানতে একটা ভাঙা পাঁচিলের পেছনে নিয়ে গিয়ে দুটো হাত সাঁড়াশির মতো শক্ত করে ধরে বলল— খুব তো ছকানোর শখ... এখন শুকিয়ে গেল কেন?”

—জানতাম... শিওর ওই মেয়েটার থেকেই...

—অন্য সেটিং ছিল... জানতে না... না?

খুব বাজে কিছুর মধ্যে ফেঁসে গেছি— বুঝতে পারছিলাম। বুকটা ঢিপঢিপ করছিল... আগে কখনও এমন হয়নি। কোনোমতে ঢোঁক গিলে তোতলিয়ে বললাম— কেন... কী করেছি আমি? ছেলেটা আমার গালে সপাটে চড় কষিয়ে বলল— অ্যাঃ! কী করিচি!... হম দো প্রেমী ছত কে উপর? টুক করে কেটে নেব... দেখবি?”

—একাই ছিল?... আশপাশ থেকে আর কেউ এল না?

—অন্য এরিয়াতে একা ফেঁসে যাওয়া খুব চাপের... বড়-বড় লোকের শর্ট হয়ে যায়। আর একটা ইস্কুলের ছেলে...

—হুম, ইস্কুলের বাচ্চাকে এমন করা... ছ্যাঁচড়া ছেলে... সব একটা মেয়ের জন্য!

চড় খেয়ে বাঁদিকের গালটা তেতে গেছিল... কানের ভেতর ঝিঁঝি ডাকছিল! সব সহ্য করে আমি চুপচাপ ক্যালানের মতো তাকিয়ে রইলাম। আর ঠিক তখনই ছেলেটা পকেট থেকে জিনিসটা বার করল, তারপর আমার তলপেটে সেটা চেপে ধরে দাঁত খিঁচিয়ে বলল— যার সাথে উড়ুউড়ু খেলছ... সে কে জানো? সবেদাবাগানের মিল্টনের নাম শুনেছ চাঁদু? ঠান্ডা জিনিসটা টাচ করতেই জাস্ট কেঁপে গেলাম। পুরো ঘামছি তখন। আর ছেলেটা ঠিক বাংলা সিনেমার ভিলেনের পাতি চামচাদের মতো খেলিয়ে খেলিয়ে বলে গেল— ও মিল্টনদার জান আছে... জান! ফার্স্ট টাইম ওয়ার্নিং দিলাম... নেক্সট টাইম দেখলে... বলে টকাস করে একটা শব্দ করল জিভ দিয়ে। কোনো উত্তর দিচ্ছি না দেখে আমার গাল টিপে দুদিকে নাড়িয়ে বলল— কী পোসেঞ্জিৎ? যা বললাম মনে থাকবে তো?... আর ওর ধারেকাছে না... হুম? কোনোরকমে ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জানানোর চেষ্টা করলাম। গুটখার ছোপধরা দাঁত বের করে হেসে ছেলেটা বলল— এইত্তো, গুড বয়!... নে চল... এবার রিটার্ন করে দিয়ে আসি।

—মেশিন নিয়ে এসেছিল?

—একটা স্কুলের বাচ্চাকে মেশিন দেখিয়ে থ্রেট দিয়েছে? শুয়ারের বাচ্চা তো একেবারে!

তখন জানতাম না ওইরকম দেখতে বন্দুককে ঠিক কী বলে, পরে শুনেছিলাম— ওয়ান শটার। আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বাইকে গিয়ে বসলাম। যে পাড়া অবধি মেশিন নিয়ে আসার সাহস দেখায়, সে পুরোই তারকাটা।’’

—সালি ছিনাল! তুমি জানতেই না যে ওর অন্য কেউ আছে? পুরো নোট্‌স-এর জন্য উল্লু বানানো কেস...

—মেশিন ঠেকিয়ে কড়কে দিয়ে গেল!... তুমি কাউকে জানাওনি? দিতে হয় এসব মালকে একেবারে রগড়ে!

—ভাই, কুঁচকিতে মেশিন ঠ্যাকালে না... এসব কথা বেরোয় না, অন্যরকম শব্দ বেরোয়... অ্যাঁ?

—তুই আর বকিস না... সেবার ভোটের আগে পেটোর শব্দ শুনেই তো তিনদিন বাড়ি থেকে বেরোসনি... ঝলমল খান আমার!

আরে কাকে কী বলব বল তো?... কী বলব? আমাকেও তো কেস খেতাম তাহলে! সামনে পরীক্ষা... আর একা বাড়ি থেকে বেরোতেও ফাটছে! বাপের জন্মে ভাবিনি যে মেয়েটার জন্য ওভাবে গান-পয়েন্টে থ্রেট খাব! ওই ছেলেটাকে না চিনলেও মিল্টন কে আমি জানতাম। বিষ মাল, টাউটার পুরো... পলিটিকাল ব্যাকিং অবধি ছিল! রাস্তায় বেরোলেই মনে হত কেউ নজর রাখছে। আননোন কাউকে বাইকে দেখলেই সাইড হয়ে যেতাম। আর কোচিং ক্লাস? দুটোই একসাথে টাটা। বাবা-মা একটু অবাক হয়েছিল, হয়তো স্যারদের জিজ্ঞেসও করেছিল আমাকে না জানিয়ে। কিন্তু আমাকে এই নিয়ে আর ঘাঁটায়নি বেশি।

—মেয়েটার সঙ্গে আর দেখা-ফেকা হয়নি?... বলোনি কিছু?

—আমি হলে দিতাম ঝেড়ে... চালাকি এক্সপোজ করে দিতাম সবার সামনে। মিল্টন-ফিল্টন যেই আসুক!

—মিলতন ফিলতন দেই আথুক!... বলব দেবাদাকে ফকিরপাড়ার কেসটা? বলব?

কোন কেস রে? ফকিরপাড়ায় আবার কী হয়েছে?”

—ও-ও কিছু না... বাদ দাও তো... এর বেশি রস।... চাপবি তুই?

—এবারের মতো ছেড়ে দিলাম... দেবাদা, তুমি ওই মেয়েটার সামনেই আর যেতে না?

তখন এই মোবাইলে ইন্টুপিন্টু চলত না; আর ওর স্কুল বা পাড়ার দিকে যাওয়ার সাহস পেতাম না। রাস্তাঘাটে হঠাৎ মুখোমুখি হলেও ওই ‘কী রে’ টাইপ হেসে কেটে পড়তাম। বুঝতে পারতাম, এই অ্যাভয়েড করা ব্যাপারটা ওর খারাপ লাগছে। কিন্তু কী কেস হয়েছিল ভেঙে বলিনি। ভয় লাগত রে ভাই। বাড়িতে যদি ব্যাপারটা যায়, আবার যদি ছেলেগুলো ধরে... খুব চাপ লাগত। বুঝতে পারতাম যে আমি ভীতু... খুব ভীতু আমি! ওর সাথে অনেকের মাঝে দাঁড়িয়ে কথা বললেও মনে হত মিল্টনের ছেলেরা নজর রাখছে। সেদিনের সেই রোগা ছেলেটাকেও মাঝেমাঝে দেখতাম আমাদের স্কুলের আশেপাশে, অথবা খেলার মাঠে। মিল্টনের ভূত সব সময়ে তাড়া করে বেড়াত আমাকে। ভয় হত— এসবের জন্য মাধ্যমিকের রেজাল্টটাই না ঝুলে যায়!”

—কিছু মনে কোরো না দেবাদা। তোমাদের পাড়ায় ইউনিটি-ফিউনিটি ছিল না। কাউকে তো একটা বলতে হয়?

—হ্যাঁ সালা... বাচ্চা ছেলে একা ভয় খেতে, টেনশন নিতে... বন্ধু-দাদা টাইপ, ক্লাবের ছেলে... কেউ তো থাকবে সালটে নেওয়ার মতো

—হ্যাঁ দেবাদা... এখন কিন্তু আমরা আছি অ্যাঁ... এমন চুপচাপ ভয়ে থেকো না। প্লিজ জানিও...

—হ্যাঁ বস... পাশে আছি বস... পুরো জিন্দাবাদ!

আর পাশে থাকা! এত চেষ্টা করে মেয়েটার কাছাকাছি গেলাম... সেই নিজের চেষ্টাতেই সরেও যেতে হল! মাধ্যমিকের পড়ার চাপ খুব হেল্প করেছিল। এসব কষ্ট ভুলতে আরও বেশি করে পড়তাম... রাতে ওর মুখ মনে পড়লে অঙ্ক নিয়ে বসতাম। ইতিহাস মুখস্থ করতাম। একেবারে টেস্ট পরীক্ষার সময়ে লাস্ট একবার ওর সাথে দেখা হয়েছিল। খুব অর্ডিনারি স্টুডেন্ট ছিল তো... পরীক্ষার আগে হেবি চাপ খেয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিল কোচিং-এর আর-একটা ছেলের সাথে... কিছু সাজেশনের উত্তর টুকে নেবে বলে। ‘না’ বলতে পারিনি। দিন সাতেকের মধ্যেই খাতাটা ফেরত দিয়ে গেল। সেই ইংরেজি নোটের খাতায় অ্যাক্টিভ টু প্যাসিভের মাঝে একটা ছোট চিরকুটে বাংলায় লেখা ছিল— ‘শুধুই কি নোটের জন্য এত কথা বলতাম?’ উত্তর আমার কাছে ছিল... ওর কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। প্রশ্ন আর উত্তরের মাঝখানে একটা ঠান্ডা ওয়ান শটার ঝকঝক করত।... এতটাই ভীতু ছিলাম সালা!”

—সেই কাগজটা এখনও রেখে দিয়েছ?... অ্যাঁ অ্যাঁ?... ঢপ দিও না---...

হ্যাঁ রে... অনেকদিন যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম... হেরে যাওয়ার ট্রফি! অনেকদিন... ওই অসহ্য সিনটা দেখার আগে অবধি।

—আবার কোন সিন?

তখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে... লাইফ আগের থেকে নরমাল। দাড়িগোঁফ গজাচ্ছে, সিগারেট ফুঁকে পুদিনহারা চিবোচ্ছি, পানু-টানু দেখছি, বন্ধুদের বাড়ির ছাদে মাংস-ভাত রান্না করে ফিস্ট হচ্ছে... টোটাল মস্তির সময়! এরই মাঝে একদিন বিকেলে অন্য পাড়ায় ফুটবল ম্যাচ দেখতে গেছিলাম... সাইকেল করে ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল... এক জায়গায় এসে দেখি হঠাৎ বোমাবাজি শুরু!”

—হঠাৎ পেটো পড়ল? ধোর! এবার গল্প টানতে জল মেশাচ্ছ...

জল মেশানো মনে হলে শুনিস না... আমারও কাজ পড়ে আছে... উঠছি তাহলে...”

—আরে দেবাদা... ও দেবাদা... এ বাবা, ক্ষেপে যেও না... ওর কথা বাদ দাও... তোমরা ক্যাচালের মধ্যে গেলেই বা কেন? রিস্ক তো!

রিস্ক আছে জানলে ওই পাড়া দিয়ে যেতাম কেন?... যাওয়ার সময়ে সব ঠিক ছিল, ফেরার সময়ে চার্জ করল... বাইরের ছেলে ঢুকেছিল, পলিটিকাল ক্ল্যাশ। ধোঁয়া, বারুদের গন্ধ। কোনওরকমে সাইকেল ঘুরিয়ে অন্যদিকে পালাচ্ছি... আমাদের পেছনেও কিছু ছেলে তাড়া করল... আমরাও তো আউটসাইডার! এক-একজন এক-একদিকে কেটে পড়ল সাইকেল নিয়ে স্যাট স্যাট করে... আর আমি কিছু না ভেবে একটা গলির মধ্যে সাইকেলটা ঢুকিয়ে দিলাম। টেনশনে বুক ঢিপঢিপ করছিল... সেই ফার্স্ট টাইম মেশিন দেখে যেমন হয়েছিল।

—একা পড়ে গেলে তো! কারও সঙ্গে থাকতে হত...

“...এ গলি-সে গলি করে পালানোর ধান্দা করছি... হঠাৎ একটা ঢ্যাঙা লোক একেবারে সামনে এসে সাইকেলটা থামাল। তারপর আমাকে সমেত সাইকেলটা টেনে একধারে নিয়ে গেল। ভাবলাম... শেষ! ধরা পড়ে গেছি! সাইকেল থেকে নামতে নামতে বললাম ‘আপনাদের কিছু ভুল হচ্ছে, আমরা ম্যাচ দেখতে এসেছিলাম... কথা শেষ করার আগেই লোকটা আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে কাছাকাছি একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল। তারপর ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। বাইরে সাইকেলটা পড়ার শব্দ পেলাম। এভাবেই সাঁড়াশির মতো শক্ত করে এর আগেও একজন ধরেছিল— মনে পড়ে গেল! লোকটা চাপা গলায় বলল ‘কেন এসেছিস, কোত্থেকে এসেছিস... কেউ জানতে চাইবে না! এই গলা আমি আগে শুনেছি... মুখে সেই গুটখার ঝাঁঝলো ভোল্টেজ আলোয় ভালো করে দেখলাম... ঠিকই চিনেছি— সে---ই ওয়ান শটারওয়ালা!”

—ভাঁড় ভেঙেছে! ওই এরিয়ার ছেলে ছিল নাকি? তোমাকে হঠাৎ পেল কী করে?

জানি না... মানে, জানতাম না কোথাকার ছেলে। অ্যাক্সিডেন্টালিই মুখোমুখি পড়ে গেছিলাম। মালটা চিনতে পেরেছিল

—পুরো হাতে হাতা! কুত্তার তাড়া খেয়ে সাপের গর্তে কেস!

হুম, সেরকমই... তবে এই ক’বছরেই ছেলেটার গাল-ফাল তুবড়ে কেমন একটা হয়ে গেছিল বুঝলি? লোক হয়ে গেছে পুরো। কিন্তু কবজিতে সেই আগের মতোই অসুরের শক্তি। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম— অ্যাসবেস্টসের চাল। একটাই ষাট ওয়াটের বাল্‌ব জ্বলছে, আর শব্দ করে ঘুরছে একটা সিলিংফ্যানমেঝের ওপর পা ছড়িয়ে বসে বুড়ি মতো একজন আমার দিকে তাকিয়েছিল। আর ময়লা চাদর পাতা খাটে বসে একটা বাচ্চা ছেলে... হাতে বই, সেও আমাদের দিকে তাকিয়ে।

বাইরে ছুটোছুটির শব্দ, চিৎকার, খিস্তি... আবার একটা বোম পড়ল। ছেলেটা আমার হাত ছেড়ে পায়ের ওপর পা তুলে খাটে বসল... যেন কিছুই হয়নি। ওর ওই ঢ্যামনামার্কা হাসি দেখেই বুঝতে পারছিলাম যে মালটা আমাকে চিনেছে, এবং বুঝেছে যে আমিও চিনতে পেরেছি।

—মেয়েটাকে নিয়ে আবার কিছু বলল? সরি-টরি চাইল?

পুরনো কথা কেউই তুললাম না। ছেলেটা কিছুক্ষণ পর বলল— ‘এখানেই কিছু খেয়ে নে... আমি নিজে তোকে পৌঁছে দিয়ে আসব’ হ্যাঁ-না কিছুই বলছি না দেখে নোংরা রকমের খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হেসে বলল— ‘এখন বাইরে বেরোলেই হাওয়া বার করে নেবেবুঝলে পাইলট?’ একদিন শুনসান এরিয়ায় নিয়ে গিয়ে একটা স্কুলের ছেলেকে মেশিন ঠেকিয়েছিল, সে নাকি সেফটির কথা ভাবছে! বিশ্বাস করবি না... সত্যিই ওর ঘরে সেদিন রাতে খেয়েছিলাম... বুড়ি মহিলা ওর মা, খুব ভালোমানুষ... ছেলেটাই স্পয়েল্ট। তাও সেদিন নর্মালি বিহেভ করছিল... বাইকে করে একেবারে আমার বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে গেল।

—এরম হয়... সেদিন ওর গুরুর কথায় থ্রেট দিতে এসেছিল... পার্সোনাল খার নেই, বুঝিয়ে দিল।

—হাহা... ছেলে পচা আলু, কিন্তু ছেলের মন ভালু। ভা--লো... ভা--লু... হেহে...

কী জানি... যাওয়ার আগে, বাইকে স্টার্ট দিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলে গেল— ‘তোর চিড়িয়া অন্য ডালে দানা খাচ্ছে... দেখেছিস?... ভদ্দরলোকের ছেলে... এই বয়স থেকে এসব মাগি-ফাগির চক্করে থাকতে নেই... বুঝলি? কী আর বলব? চুপচাপ শুনে গেলাম... হোপলেস ব্যাপার। পরে একদিন সত্যিই দেখলাম মেয়েটাকে... মিল্টনের পেছনে বসে বাইকে চড়ে কোথায় যাচ্ছে। চোখমুখে সেই আগের ইনোসেন্স আর নেই! ছেলে-চড়ানো টাইপ লাগছিল... রাগ হচ্ছিল বলেই হয়তো আরও বিচ্ছিরি লাগছিল...”

—এহ!... তারপর?

তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে এলাম, পুরনো অনেককিছুর সাথেই কানেকশন কাট হয়ে গেল। শুনেছিলাম মেয়েটা উচ্চমাধ্যমিকে গাড্ডা খেয়েছে। খাওয়ারই কথা। আর সেই চিরকুটটার যে কতগুলো টুকরো করেছিলাম... হেহ্‌!”

 

... .... ... ... ...

 
এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলাম। মনে হল— গল্প বা ঘটনা যা-ই হোক... এখানেই শেষ। দেবার্ঘ্যদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যস? এভাবেই সম্পর্কটা শেষ হয়ে গেল? আর কখনও দেখা হয়নি পরে? এখন কোথায়... কেমন আছে...”

দেবার্ঘ্যদা চায়ের গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে সেটা মেঝেতে নামিয়ে রাখল। তারপর জানলার বাইরে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, হুঁ, দেখা হয়েছিল তো... সে আর-এক চব্বো!”

—এ আলাদা রকমেরই লাভ স্টোরি... ছোটি সি হয়েও ছোটি সি হচ্ছে না...

—ছোটি না হয়ে... চটি হওয়ার দিকে এগোচ্ছে...

না না... যে ধাক্কা খেয়েছিলাম, ঘেন্না ধরে গেছিল সালা। নিজের ওপর রাগ হত! মেয়েটার কথা মাথায় এলেই ওই মেশিন ঠেকানো ছেলেটার মুখ আর মিল্টনের মুখ মনে পড়ে যেত! তাছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের লাইফ পুরো আলাদা... নতুন গ্রুপ... নতুন রিলেশনের জন্য মাথা খেলানো। আলাদাই লাইফ!

তবে শেষ একবার দেখা হয়েছিল... সেও মনে রাখার মতো... ফাইনাল ইয়ার... গার্লফ্রেন্ডের কলেজের ফেস্টে গেছি...”

—ওহ বউদির সাথে তাহলে ওই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তেই আলাপ?

দূর! এ মালটা কে?... বউদি তখন কোথায়!... যা বলছি শোন না...

ফাইনাল ইয়ার, তার ওপর গার্লফ্রেন্ডের কলেজ... বুঝতেই পারছিস। ফেস্টের দিন বিকেলে গিয়ে দেখি গার্লফ্রেন্ডের সাথে সেই মেয়েটাও দাঁড়িয়ে আছে... যার সব কথা চার বছর আগে ওই চিরকুটের সাথে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম!”

—মালটা তোমার গার্লফ্রেন্ডের কলেজেই পড়ত নাকি?

—হাহাহাহা... তোমার গালফেন্ড জিজ্ঞেস করেনি কিছু?

—দেখে পুরো শুকিয়ে গেছিল?

আরে আমি কী করে জানব যে ও একই কলেজে পড়ে! বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে... আমারও অড লাগছে, নর্মালি কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছে গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে... দু’জনেই দু’জনকে আড়চোখে দেখছি... বিচ্ছিরি চাপ! ভাবছি কীভাবে গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ওখান থেকে কেটে পড়া যায়! যদি পুরনো কথা তুলে কেস খাইয়ে দেয়... সিনক্রিয়েট হয়?”

—চুপচাপ থাকলে ভালোই... টাইম মতো সরে পড়তে হয়...

আমরা দুজনেই ফার্স্ট দেখা হওয়ার মতো হাই-হ্যালো করে চেপে গেছি। ও বুঝতেই তো পারছে যে পাশে যে আছে সে-ই আমার গার্লফ্রেন্ড। এদিকে, আমার খালি মাথার মধ্যে ঘুরছে ‘কী কী কথা হয়ে থাকতে পারে ওদের মধ্যে আমাকে নিয়ে? চটপট কায়দা করে বান্ধবীকে নিয়ে আলাদা জায়গায় চলে গেলাম আমার অন্য বন্ধুদের সাথে দেখা করাতে... মেয়েটাকে হালকা করে কাটিয়ে দিলাম।

—ব্যস! মিটে গেল!

মিটে আর কী গেল... এবার আসল কেসটা শোন! সন্ধের সময়ে কোন একটা ব্যান্ড সাউন্ড চেক করছে... আর আমার বান্ধবী হোস্টেলে গেছে মেকআপ-ফেকআপ করতে, আমি সাইড খুঁজে একটা চেয়ারে বসে সিগারেটটা সবে মুখে নিয়েছি... হঠাৎ দেখি সেই মেয়েটা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে!”

—উফ, কী ব্যথা! পুরনো চাপ...

—পুরনো পাপ...

ব্যথা-ফ্যাথা নয়... ইরিটেটিং লাগছিল। ও নিজেও বুঝেছিল আমি অ্যাভয়েড করছি। আস্তে আস্তে আমার কাছে এসে বলছে ‘কীরে, একেবারেই কি চেনা ঠেকছে না? আমিও ফেক হেসে বললাম ‘হ্যাঁ হ্যাঁ... টিউশনে পড়তাম তো... তারপর কী খবর, এখানে কোন স্ট্রিম? জানলাম আমার থেকে এক বছরের জুনিয়র, হিসেব মতো তাই-ই হওয়া উচিত... এইচ এস-এ ফেল করেছিল ফার্স্ট টাইম। ফেল করেও ইঞ্জিনিয়ারিং অবধি এসেছে দেখে স্ট্রেঞ্জ লাগল। দু’-চার কথার পর হঠাৎ বলে ‘তোর বান্ধবী তোর মতোই লেখাপড়ায় ভালো, তাই না?’ আমি ‘ওই আর কি’ বলে গার্লস হোস্টেলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর ও মাথা নীচু করে আস্তে আস্তে বলল ‘সেই ভালো, তাহলে ভালোই আছিস।’ এই ভালোই আছিস’-এর টোনটা সহ্য হল না। আমিও ইচ্ছে করে হার্ট করার জন্য বললাম ‘তুই-ই বা খারাপ কী... এদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের লাইফ... ওদিকে মিল্টন...’ মিল্টনের নাম শুনে শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল মেয়েটা। কেমন একটা অদ্ভুত ভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। সেই প্রথম ওকে ভালো করে দেখলাম— মুখচোখে কেমন ফ্যাকাশে ভাব। মেকআপ করেও ডাল লাগছে।

দেবার্ঘ্যদা... জোর করে অস্বীকার করছ। আসলে চিরকুটটাই শুধু ছিঁড়তে পেরেছিলে... আর কিছু না। কথাগুলো না বলে পারলাম না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথাটা দু’দিকে নাড়াল দেবার্ঘ্যদা। তারপর বলল...

এখনও স্পষ্ট মনে আছে... কথাগুলো শোনার পর কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটটা কাঁপছিল, চোখ দুটোও ছলছল করছিল। কিন্তু আমার মধ্যে একইরকম ইনডিফারেন্স দেখে একটু হেজিটেট করে শুধু বলল ‘যা, ফেস্ট এনজয় কর... এখনই তোর গার্লফ্রেন্ড এসে পড়বে।’ তারপর একটু থেমে বলল... ‘শোন... একটা রিকোয়েস্ট করব? শুধু জিজ্ঞেস করলাম ‘কী? ঠোঁট কামড়ে একটু চিন্তা করে বলল ‘আমি এইচ এস-এ ফেল করেছিলাম, একথা কেউ জানে না এখানে... প্লিজ এটা কাউকে বলিস না... রিকোয়েস্ট করছি।’ খুব এক্সপেক্টেড রিকোয়েস্ট। ‘ইটস ওকে... আমার তো মনেই ছিল না! এইসব বলে সিগারেট ফেলে গার্লস হোস্টেলের দিকে দু’-পা এগিয়ে গেলাম। মেয়েটাও থ্যাংক্‌স বলে চলে যাচ্ছিল... হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে, পেছন ফিরে আমার দিকে তাকাল, তারপর কেমন একটা ধরে আসা গলায় বলল ‘মিল্টন আমার জ্যাঠতুতো দাদা হয়’

আর দাঁড়াল না... পাঁচিলে বসা ছেলেদের ইয়ার্কি শুনে যেমন তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলে যেত, ঠিক সেইভাবে প্রায় দৌড়ে হোস্টেলের দিকে চলে যেতে দেখলাম। মনে হল, চোখের জলও তাড়াতাড়ি মুছে নিল হাত দিয়ে... তারপর... হারিয়ে গেল।

চাদ্দিকে তখন কী আওয়াজ! গ্রাউলিং করছে লিড ভোকালিস্ট... টেরিবল এক্সপিরিয়েন্স গ্রাউলিং-এর সময়ে সাউন্ড-সিস্টেমের কাছাকাছি থাকা!”

দেবার্ঘ্যদা গ্রাউলিং-এর কথা বলে হালকা হওয়ার চেষ্টা করছিল... কিন্তু যারা এতক্ষণ ফোড়ন কাটছিল, ওরাও দেখলাম চুপ করে গেছে একেবারে। যারা ক্যারাম খেলছিল, তারাও স্ট্রাইকার বোর্ডে ফেলে রেখে বসে আছে দেবার্ঘ্যদার দিকে তাকিয়ে। বুঝতে পারছে না কীভাবে হালকা করবে ব্যাপারটা।

আমিই বলে ফেললাম, ‘‘এটা কেমন হল! দাদা-ই যদি হবে, তাহলে জান হয় কী করে?... তুমিই বা থ্রেট খেলে কেন?’’

দেবার্ঘ্যদা মাথা নেড়ে বলল, কী জানি ভাই! আমারও মাথাটা ঘেঁটে যায় এসব পুরনো কথা মনে পড়লে... ঠিক বুঝতে পারি না। খারাপ একটু লাগে... কিন্তু সে সময়ে আবার করে পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটা... তখন অলরেডি একটা রিলেশনে, কমিটেড... কী হবে বল? কিছু কি আর ফিরে আসত?”

—এহ... লাইফের ফার্স্ট লাভ... এভাবে অফ সাইড হয়ে গেল?

—আর ফার্স্ট লাভ... তার চক্করে যে সেকন্ড লাভটা ঘেঁটে যায়নি এই অনেক।

দেবার্ঘ্যদা উঠে ক্লাবঘরের দরজার দিকে এগোচ্ছিল, পায়ে চটিটা গলিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, লাভের ফার্স্ট, সেকন্ড কী বে সালা?”

শঙ্খদা আমাদের মাঝে একটু গাছপাকা টাইপ... একটা স্ট্রাইকার সোজা বিডে মেরে বলল, ‘‘ফ্যান্টাস্টিক! একেশ্বরবাদের ফার্স্ট ক্লাস দৃষ্টান্ত!”

দেবার্ঘ্যদা ক্লাবের বাইরে থেকেই হেঁকে বলল, পায়রার বক্ষপিঞ্জরে কি বাঘের জিগরা হয় রে ভাই... ওসব শ্যালো মাইন্ডেড বুর্জোয়াদের জন্য নয়!”

একটা সাইকেল-রিকশা চলে গেল পঁক-পঁক করে জোরে হর্ন দিতে দিতে। স্ট্রাইকারটাও দু’-তিনটে বিডে রিকোশে করে গেল।

অন্য ঘুঁটিতে ধাক্কা দেওয়ার থেকেও বেশি শব্দ করে স্ট্রাইকার... যখন বিডে ধাক্কা খায়।


 

3 comments:

  1. ওই রোগা ছোকরাটার চাপ ছিল মনে হচ্ছে। মিল্টনের নামে ভয় দেখিয়ে কাটিয়ে দিল। 😀
    তোমার রেগুলার ডিপ্রেসিং সাইকো থ্রিলারের মাঝে একটা নতুন ধরনের, একটু হালকা। আরামদায়ক।

    ReplyDelete