বাক্‌ ১৪৫ ।। পিয়া সরকার

 

জীবনীয়

 

সুধীন ওর রুপোলি ফ্রেমের চশমাটা নাকের উপর অ্যাডজাস্ট করতে করতে বলল, ‘এই ঘরটা তোর জন্য ঠিক করলাম। ভালো না? খোলামেলা আছে বেশ।’

ঘরটা সত্যিই বড়। প্রায় দরজার সাইজের চারখানা জানালা দিয়ে মাঝ সকালের রোদ ঝাঁপিয়ে পড়ছে মেঝেতে। হালকা হলুদ রঙের দেওয়াল, কাঠের মেঝে,  আসবাবপত্রের বাহুল্য নেই। ঠিক আমার যেমনটা পছন্দ। দক্ষিণ দিকের জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা সামান্য উঁচু টিলা চোখে পড়ল। টিলার মাথায় একটা নাম না জানা গাছ, তার নীচে ছোট্ট একটা মন্দির। সুধীনের বনবাংলোর পিছন দিক এটা। এখান থেকে চিত্রকূট জলপ্রপাত মাইল পাঁচেকের রাস্তা। জলপ্রপাত দেখার বিশেষ ইচ্ছা নেই আমার তবু জানি সুধীন ঠিকই টেনে নিয়ে যাবে। বন্ধুকৃত্যে সে কোনো ত্রুটি রাখতে চায় না।

মাস ছয়েক আগে যখন রোগটা ধরা পড়েছিল, একে-একে সব বন্ধুদের সঙ্গেই যোগাযোগ কমিয়ে ফেলেছিলাম। লেখালেখির মধ্যগগনে কোনো লেখকের মারণ-অসুখ ধরা পড়লে যে সহানুভূতির স্রোতটা হঠাৎ আছড়ে পড়ে, মেইলে, ইনবক্সে, ফোনে সেটা সামাল দেওয়ার মতো মনের জোর আমার ছিল না। সব ঠিক হয়ে যাবে বাক্যটা শুনলেই মনে হত, আরও এক কদম মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গিয়েছি আমি। তবু, সুধীন কেন, কীভাবে টিকে গিয়েছিল আমি জানি না। আমার অসুখটা খারাপ, স্টেজ থ্রি প্রোস্টেট ক্যান্সার। চারটে কেমোর সিটিং হয়ে গেছে, আরও তিনটে বাকি।  সুধীন একদিন ফোন করে ধৈর্য ধরে শুনেছিল সবটা।

এখানে এরকম হুট করে চলে আসাটা ওর পাল্লায় পড়েই। ও আমারই মতো অকৃতদার। নির্বান্ধব বনভূমিতে বনতাপসের মতো জীবনযাপন ওর। সরকারি খরচায় অবশ্য। প্লেনটা এলাদাবাদ ল্যান্ড করতেই গাড়ি নিয়ে হাজির, তারপর প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করে এনে ফেলেছে এখানে। সুধীনের বাংলোয় লোক বলতে এক খুনখুনে বুড়ি ও তার অল্পবয়স্ক নাতনি। বাংলো থেকে একটু দূরে একটা সারভ্যান্ট কোয়ার্টারে ওরা থাকে। ওদের চাকরি সরকারি নয়। কাছেই দুলভি বলে গ্রামটার বাসিন্দা ওরা। সুধীনের দেখাশুনা করে বলে সারভ্যান্ট কোয়ার্টারটা খুলে দিয়েছে সুধীন। মাইনেপত্তর নিজের পকেট থেকেই দেয়। আমার লাগেজগুলো দোতলায় বয়ে এনে দিয়েছে মেয়েটা। নাম দুলালি। দুলভি গ্রামের সবার নাম ‘দ’ দিয়ে শুরু হয়। দুলারি, দুলালি, দৌলতরাম, দুখু... ভারী অদ্ভুত নিয়ম।

দুলালি শীর্ণ, শিরা বার করা হাতে আমার লাগেজগুলো যখন টেনে এনে মেঝের উপর রাখল, তখনই খুঁটিয়ে দেখলাম ওকে। অপুষ্ট শরীরে বুকদুটো পাঁজরের সঙ্গে মিশে গেছে, গলার কণ্ঠা বেরিয়ে আছে গোলগলা কামিজের ফাঁক দিয়ে, ঠোঁটের পাশে সাদা খড়ি উঠেছে, নখে জমাট বাঁধা ময়লা। বয়স কত তা বলা মুশকিল, আঠারোও হতে পারে, চোদ্দোও হতে পারে। ও শিশু নয়, কিশোরী নয়, যুবতীও নয়। সময় ওকে ওর বয়সের সংজ্ঞা দিতে ভুলে গেছে। 

সুধীন এক ঝলক ওর দিকে তাকিয়ে আমাকে হেসে বলল, ‘ভয় নেই। এ রান্না করবে না। রান্না আসে বনবিভাগের ক্যান্টিন থেকে। অন্য যা যা কাজ আছে ওকে বলবি।’ একটু হাসলাম। অন্য কাজ আর কী-ই বা আছে। জামাকাপড় যাতে কাচতে না হয়, একগাদা প্যাক করে এনেছি। বাকি কাজ সব ব্যক্তিগত। সুধীন বলছিল খাতাকলম আনতে, ও জানে আমি সেই পুরোনো কায়দায় বিশ্বাস করি। নিয়ে এসেছি বটে, যদিও জানি না এক কলম লিখতে পারব কিনা!

রাত্রিবেলা খাওয়াদাওয়ার পর জানালার ধারে গল্পগুজব করতে বসলাম। এটা সেই জানালাই, যেটা দিয়ে একটু দূরের টিলাটা দেখা যায়। গাছটার তলায় ছোট্ট মন্দিরটা এখন আর দেখা যাচ্ছিল না। গাছের পাতাগুলো চাঁদের আলোকে যেন গিলে নিয়েছে। নীল-কালো কালি মাখানো আকাশে সোনালি চাঁদ একা তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে। তার ঠিক নীচে ঝুপসি গাছটাকে দেখে মনে হচ্ছিল, এই নির্জন বনভূমিতে ও যেন নিজেও একটা চরিত্র। সুধীনকে বললাম, ‘ভারী অদ্ভুত তো ওই গাছটা! ওই মন্দিরটায় কে পুজো করে? সকালে বা সন্ধেয় তো কাউকে দেখিনি?

সুধীন নরম হাসল। তারপর সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘ধুর! এসব এখানকার মানুষের উদ্ভট বিশ্বাস।’ কীরকম জিজ্ঞাসা করাতে সুধীন একটু ইতস্তত করল। তারপর বলল, ‘আসলে এরা এত গরিব, কঠিন অসুখবিসুখ করলে চিকিৎসা করতে পারে না। সরকারি হাসপাতাল ধর, প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে। মেইন রোডে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলতে সারা দিনে একটা বাস। এরা কী করে, রোগযন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা মানুষগুলোকে ওই গাছতলায়, মন্দিরের সামনে চাতালে ফেলে রাখে। ওদের বিশ্বাস, গাছটা নাকি রোগজ্বালা গিলে নেয়। তারপর আস্তে আস্তে মানুষটাকেও

মানে!

সুধীন সিগারেটের ছাইটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়। অনেক রাত হল। তোর সামনে যে সিগারেট খাওয়াটা উচিত নয়, ভুলে গিয়েছিলাম। তুইও মনে করাসনি।’

পরদিন সকালবেলা ও যথারীতি অফিস চলে গেল। ফরেস্ট রেঞ্জারের সেই অর্থে নিশ্চয়ই অনেক দায়িত্ব। তবু ও প্রতি পদে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দেখে খারাপ লাগছিল। আজ অফিসে যেতে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম।

বনবাংলোতে এর আগেও সময় কাটিয়েছি। সে সব সময় নেহাতই শৌখিন, সেসব হাতড়েই কলমের আঁচড়ে ক’টা মুগ্ধ বাক্য বেরিয়ে এসেছে বারবার। তারপর সেই বাক্য পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়ে পাঠকের অন্দরমহলে পৌঁছেছে। কিন্তু এখন এই নির্জনে কাটাতে ঠিক ভালো লাগছিল না। হাতে সময় বিশেষ নেই। কাঁকড়াবিছের কামড় খেয়েছি। এখন বিষটুকু রক্তে নিঃশেষে মিশে যাওয়ার অপেক্ষা। পৃথিবীর কোনো কেমোথেরাপি সেই বিষকে জয় করতে পারবে না, আমি বুঝতে পারি। প্রতিবার ডাক্তারের ক্যাজুয়াল মুখটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, তিনিও সে কথা জানেন। এ এক অদ্ভুত সাম্যের সময়। জীবনের ওঠাপড়া বিশেষ ভাবায় না। শুধু মাঝেমাঝে একটা অস্থিরতা হয়, আর একটা ক্ষীণ আলোর রেখা দেখতে পাই— যার নাম আশা। উঁচু-নীচু শাল, সেগুন, অর্জুন, গরানের ভিড়ে ঠাসা জঙ্গলটার দিকে তাকালাম। সরু রাস্তাটা ক্রমশ একটা বিন্দুতে গিয়ে মিশেছে। বাংলোর সামনের হাতাটায় বারান্দায় ঝকঝকে আলো এসে পড়েছে। বুড়ি আর তার নাতনিকে দেখতে পাচ্ছিলাম না।

বাংলোর পিছন দিকটায় যেতেই সেই টিলাটার দিকে নজর পড়ল। ঝুপসি গাছটার নীচে ছোট্ট তিনকোণা মন্দিরটা দাঁড়িয়ে আছে একই ভাবে। ছোট্ট পায়ে চলা রাস্তাটার শেষে পাথরের টুকরো বসিয়ে সিঁড়ি বানানোর চেষ্টা হয়েছে। দুলালি কুয়ো থেকে জল তুলছিল, আমাকে দেখে ওর মাথা নীচু করে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। মন্দিরটা আর ওই গাছটা আমাকে টানছিল। ওদিকে এগোতেই একটা কণ্ঠস্বর আমাকে বাধা দিল, ‘মত যাও বাবু। উঁহা যানা মনা হ্যায়।’ দুলালির ঠাকুমা কোথা থেকে যেন এসে উপস্থিত হয়েছে।

‘কিঁউ?

‘মালুম নহি বাবু। উসকে পাস ওহি যায়েগা জিসে ওহ খুদ বুলায়েগা।’

‘কিসকো বুলায়েগা?

‘মালুম নহি! বস আপ মত যাও।’

বুড়িটা কুঁজো হয়ে হেঁটে চলে গেল। আশ্চর্য ব্যাপার তো! একটা মন্দিরে কেন যেতে পারব না। সুধীন আসতেই এটা-সেটা কথার পর আবার ওই প্রসঙ্গ তুললাম। সুধীন হেসে বলল, ‘তুই কি অবসেসড হয়ে পড়লি নাকি! আরে ওরা বিশ্বাস করে, যাদের মৃত্যু আসন্নতাদেরকে যদি ওই গাছ দয়া করে, তবে তারা নাকি একটা বিশেষ গন্ধ পায়। রাত নামলে সেই গন্ধ বাষ্পের মতো সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। সেই গন্ধের টানে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ নিজেই চলে আসে মন্দিরে। আর তারপর

‘তারপর?

সুধীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘পরদিন ভোরবেলা তার প্রাণহীন দেহ পাওয়া যায় চাতালে।  সব যন্ত্রণা সাঙ্গ করে মৃত্যু নেমে এসেছে শরীরে। ওরা বলে ওদের আত্মাকে নাকি গিলে নেয় গাছটা। ওই মন্দিরে পুজো দেওয়াও বারণ। ওরা কেউ যায় না অন্য সময়।’

‘সত্যি এমন হয় নাকি?

‘জানি না। তবে দু’-চারবার দেখেছি লোকাল আদিবাসীরা মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে গেছে চাতাল থেকে। এই গ্রামে নাকি কেউ কষ্ট পেয়ে বিছানায় পচে মরে না। সর্ট অফ ইউথ্যানাসিয়া। দৈব প্রেরিত। সবই ওদের বিশ্বাস বুঝলি কিনা! এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজতে যাস না। ঘুম পেয়েছে আমার, কাল সকালে আবার অফিস আছে। ঘুমিয়ে পড় রঞ্জন।’

সুধীন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি অনেকক্ষণ জেগে রইলাম। একবার উঠে কাচের জানালার পর্দা সরিয়ে গাছটার দিকে তাকালাম। চাঁদের আলো বিস্ফোরণের মতো গাছটার পাতায়-পাতায় ছিটকে পড়ছিল। বন্যার মতো সেই আলো ঠিকরে এদিকেও এল। পাল্লা খুলে নাক বাড়ালাম, কিন্তু বুনো জংলি গন্ধ ছাড়া আর কিছু পেলাম না। গাছটা একটা ভ্যাম্পায়ারের মতো দাঁড়িয়েছিল, কাদেরকে ও মরণডাক পাঠায় কে জানে!

 

পরদিন পেট গুলিয়ে বমি হলএটা কলকাতায় থাকতেও বেশ কয়েকবার হয়েছে। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। সুধীন কাঁচুমাচু মুখে বলল, ওকে আজ এলাহাবাদ যেতেই হবে। হেড অফিসের জরুরি তলব এসেছে ফোনে। ওকে একটুও চিন্তা না করে চলে যেতে বললাম। ভীষণ কিন্তু কিন্তু মুখ করে ও বেরিয়ে গেল। বমি পরিষ্কার করতে দুলালি এসেছিল। এমন ভাবে পরিষ্কার করছিল যেন ভাতের এঁটো মুছছে। নোংরা কাজ এত ধৈর্য নিয়ে করতে আগে কাউকে কখনও দেখিনি।

মেয়েটার সঙ্গে একটু ভাব জমানোর চেষ্টা করলাম। মেয়েটা যেন কেমন! যাই বলি, মরা মাছের মতো তাকিয়ে থাকে। বুদ্ধি নেই, বাক্য নেই, শুধু স্থিরতা আছে। নাকি জীবনযন্ত্রণা সহ্য করার সব সীমারেখা পেরিয়ে গেছে বলে স্নায়ুগুলি অমন অসাড় হয়ে গেছে! সুধীন বলছিল, ওর বিয়ের কথা চলছে। বিয়ের সময় যদি এখানে থাকতাম, হয়তো হাসলে ওকে কেমন লাগে তা দেখতে পেতাম।

রাত নেমে আসতেই গাছটা আমাকে আবার গ্রাস করল।  সারাদিন একরকম ভাবে চলে, আর রাত আসলেই মৃত্যুর সেই অদৃশ্য দেবতা আমাকে মোহগ্রস্থ করে দেয়। জীবনের কোন ছিদ্রপথে মৃত্যু এসে স্পর্শ করবে, তা ভেবেই মানুষ ভয়ে কাটিয়ে দেয় সারাজীবন। আজ যখন জানি, সেই অতলস্পর্শ অন্ধকারই আমার নিয়তি, তখন সেই যাত্রা মধুর কেন হবে না? গাছটার দিকে হ্যাংলার মতো তাকিয়ে রইলাম। আদিম অন্ধকারের মতো সেও নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমার শরীরের প্রতিটা কোষ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী, একে অপরকে অক্লান্তভাবে খেয়ে চলেছে। আমার যাবতীয় শারীরিক যন্ত্রণাকে পেইনকিলার দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। একবারের ডোজ মিস করলেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি না। এর পরে কী? লেখা গেছে, রূপ গেছে, টাকাপয়সা জলের মতো খরচ হয়ে গেছে, বিছানায় শুয়ে মলমূত্রে লেপে যাওয়া ছাড়া আর তো কোনো পরিণতি নেই! তবে কেন মৃত্যু মধুর হয়ে নেমে আসবে না? কেন এই নিস্তব্ধ বনভূমির দেবতা আমার উপর দয়া করবে না!

          বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হল, গাছটার দিক থেকে পিছন ফিরিয়ে বসি। এরকম নির্লজ্জ ভাবে আবাহন করছি বলেই হয়তো সেই গন্ধ পাচ্ছি না। কাঠের মেঝেতে রুপোলি জ্যোৎস্না ছড়িয়েছিল। আহা সে কেমন মৃত্যু হবে! যে আমায় পরম আশ্লেষে নিজের দিকে টেনে নেবে। তীব্র রোমান্টিক গম্ভীর নির্বিষ যে দহন!

ধীরে ধীরে চাঁদ আমার জানালার আরও কাছে এগিয়ে এল। ডেস্কের উপর, ঘরের দেওয়ালের উপর, দরজা জানালার ফ্রেমের উপর আলো পড়ে ভাস্বর হয়ে উঠল। ঠিক যেন দিনের বেলা, অথচ আলোয় জ্বালা নেই। আর ঠিক তখন, তখনই মনে হল আমার পিঠের পিছনে জানালার কাছে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। আমি পাথরের মতো জমে গেলাম, ছায়াটা দীর্ঘ হয়ে মনে হল ঘরের মধ্যে ঢুকল। মেঝের উপর জ্যোৎস্না যেন ঘন হল। তবে কি সে আসল?

চারিদিক এত চুপ, ঝিঁঝিপোকাও ডাকে না। চোখ শক্ত করে বন্ধ করে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম, কখন সে গন্ধ আমাকে ডাক পাঠায়! কখন মাতাল হয়ে আমি তার দিকে ছুটে যাই! সে কি প্রথমে আমাকে স্পর্শ করবে, নাকি আমার প্রৌঢ় কাঁধে-পিঠে হাত বুলিয়ে ডাক পাঠাবে? হঠাৎ একটা খচরমচর শব্দ হল, জানালার নীচে। কে যেন দূরে কেঁদে উঠল। কুকুর কি? ভাদ্রমাসে রতিপীড়িত কুকুরির মতো সেই চিৎকার!

তারপর আবার সব শান্ত। মুহূর্তের পর মুহূর্ত কেটে গেল, আর কিছু হল না। বিরক্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। যে আসবে বলে নাইটল্যাম্পও জ্বালাইনি, এখন একের পর এক টিউবলাইট জ্বালিয়ে দিলাম। সব ক’টা ঘরের, বাথরুমের, বারান্দার। রাত মরে এসেছে। আদিবাসীদের ব্লাফও আমার কাছে মরে গেল চিরতরে। একটা টিনেজ বাচ্চার মতো গোলগাল গল্পে বিশ্বাস করে নিজেরই লজ্জা লাগছিল। এ কী ভীমরতিতে ধরল আমায়! সুধীনের দেওয়া মেডিকাল লিটারেচারগুলো মনে পড়ল, স্টেজ থ্রিতে থেকেও কত মানুষ ফিরে এসেছে। এখনও এত নিরাশ হওয়ার মতো কিছুই হয়নি।

ঘরে ঢুকে বিছানাটার দিকে গেলাম। ক্লান্ত লাগছিল। হয়তো ঘুম আর আসবে না, হয়তো ম্যাগাজিনের পাতা উলটেই কেটে যাবে রাত। জানালার পাল্লাটা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য উঠলাম। লজ্জায় গাছটার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। প্রথম জীবনে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে যে অপমান বোধ করেছি, তার চেয়ে এ কি কোনো অংশে কম? ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষারত বুদ্ধিহীন একটা মানুষ আমি! চোখটা হঠাৎ গাছের উপর পড়লএমন একটা কিছু দেখলাম যে খটকা লাগল।

ছুটে নীচে নেমে এলাম। গাছটার কাছে আমাকে পৌঁছাতেই হবে। কোনো বাধানিষেধ মনে থাকল না। ছোট রাস্তাটা বেয়ে দৌড়িয়ে, পাথরের সিঁড়িগুলো পেরিয়ে গাছটার কাছে পৌঁছাতেই দেখলাম শীর্ণ এক শরীর গাছটার ডাল থেকে লকেটের মতো ঝুলছে। তার পায়ের কাছে একটা কাঠের টুল উলটে পড়ে আছে। চাঁদের আলো তার মুখের উপর জমাট বেঁধেছে। গাছটার ঝুপসি অন্ধকার সেই আলোর গতিপথ স্তব্ধ করতে পারেনি। যন্ত্রণাশূন্য সে মুখ অপরূপ লাগছিল। কিছুক্ষণ আগে সেই খচরমচর শব্দ, সেই হাহাকারের কারণ স্পষ্ট হল আমার কাছে। দুলালি মোটা শক্ত দড়ি ব্যবহার করেছে। যে মৃত্যুতে ওকে এত অপরূপ লাগছিল, তার সামনে দাঁড়িয়ে এবার আমি কেঁপে গেলাম। অজানা সেই শক্তি, আদিম সেই দেবতা যেন বজ্রদন্ত বার করে আমাকে দেখালেন— আমার শারীরিক অসুস্থতা, আমার নৈরাশ্য গিলে নিয়ে বলে উঠলেন— তুমি প্রস্তুত নও! এই পবিত্র দেবভূমিতে ডাক পাওয়ার অধিকার নেই তোমার। নিঃস্বতম, রিক্ততম আত্মার এই পীঠস্থানে তোমাকে আমরা বর্জন করলাম!

 

সুধীনের মুখ গম্ভীর। দুলালির বডি নিয়ে গেছে পুলিশ। গতকাল দুপুরে ওর বাগদত্ত ছেলেটি নাকি মাওবাদী সন্দেহে, পুলিশের গুলিতে মারা গেছে বস্তারের কোনো এক পাহাড়ে। সেই খবর এখানে পৌঁছাতে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল।

আমি সুধীনকে বলেছি ওই ঘরটায় আর থাকব না। বাংলোর সামনের দিকের কোনো একটা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে, যতক্ষণ না এলাহাবাদে প্লেনের টিকিটের ব্যবস্থা হয়।

দুলালির ঠাকুমা একটা ঘর খুলে ঝাড়াপোঁছা করছিল। বুড়ি নিরুত্তাপ। কুঁজো পিঠ ঝুঁকিয়ে একমনে ঝাঁট দিচ্ছিল। আমি ঘরে ঢুকতেই সে আমার দিকে তাকাল। তার ঘোলাটে বাদামি চোখে কী যেন ঝিকমিকিয়ে উঠল। ঝাঁট দিতে দিতে আমার কাছে এগিয়ে এসে দুলালির ঠাকুমা আমার দিকে সোজা তাকাল। বাইরে শাল-গরানের বনে যেন একটা ঝড় উঠল। আমার মনে হল অট্টহাস্য!

9 comments:

  1. গায়ে কাঁটা দিল। পার্থিব অপার্থিব,বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলা পেরিয়েও কোনও অতীন্দ্রিয় অস্তিত্বের উপস্থিতি গল্পটিকে জড়িয়ে রেখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। আবহনির্মাণ এবং পরিণতির রহস্যময়তা তাকে সুখপাঠ্য করেছে আরও।

    ReplyDelete
  2. অনেক ধন্যবাদ সপ্তর্ষি

    ReplyDelete
  3. আমি আগেই পড়েছিলাম। আজও পড়লাম। অসামান্য হয়েছে। বিশেষ করে আবহনির্মাণ।

    ReplyDelete
  4. খুব অন্যরকম ভাল গল্প। মৃত্যুপথযাত্রীর মনের কথা, গল্পের টুইস্ট, প্রতিটিই অন্যরকম। খুব ভাল লাগল

    ReplyDelete