আমাদের পাড়া
আমাদের পাড়াটা খারাপ পাড়া বলেই সবাই জানেন। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ থেকে আমাদের গলিতে ঢুকলে আমাদের পিছনের বাড়ি থেকেই সন্ধ্যাবেলা গানের আওয়াজ ভেসে আসত। আমি বড় হয়েছি ওই পাড়াতেই। তাই অস্বস্তি হত না।
অধ্যাপকের সন্তান। মা নিজেও অধ্যাপিকা। তাই পাড়াতে সবাই আমাকে অন্য চোখে দেখতেন। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। মায়ের সঙ্গে বাসে করে কলেজ স্ট্রিট থেকে ফিরছি। এক মহিলা জোর করে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাকে বসালেন। তারপর আমাদের সঙ্গেই বাস থেকে নেমে গলির ভিতরে চলে গিয়েছিলেন। যাবার আগে হাফপ্যান্ট পরা আমার মাথায় হাত দিয়ে সেই মহিলা বলেছিলেন, ‘বড় হয়ে বাবা-মায়ের মতন পড়াশুনোতে ভালো হতে হবে কিন্তু’।
আর-একটু বড় হয়েছি। ক্লাস টেনে পড়ি। আমার এক বন্ধুর বাবাকে দেখেছিলাম ওই মহিলার বাড়ি থেকে বেরোতে। মা বলেছিলেন ক্লাসে এগুলো কখনও যেন আলোচনা না করি কারওর সঙ্গেই।
তখন কলেজে পড়ি। সুবীরের মামার ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকোমিয়া ধরা পড়েছে। একদিন রাত সাড়ে আটটায় এক বন্ধু ফোন করে বলেছিল ব্লাড লাগবে। মেডিকেল ব্যাংক থেকে ওই ব্লাড গ্রুপের একজন ডোনারের ঠিকানা জোগাড় হল। দেখা গেল ভদ্রমহিলা আমাদের পাড়াতেই ভিতরের গলিতে থাকেন। আমার সঙ্গে মেডিকেল কলেজে গিয়ে সুবীরের মামাকে রক্ত দিয়ে এসেছিলেন সেই মহিলা।
সার্কাস
বাবার ফটোতে ধূপ দিয়ে সামান্য দাঁড়িয়ে ছিলেন বছর পঞ্চাশের সুধাদত্ত জেনা। সার্কাস কোম্পানি গ্রামে জাগলার খুঁজছে। ছেলের কেরালার চাকরির টাকায় অন্নসংস্থান আর গ্রামীণ যোজনার টাকায় পাকা বাড়ির সুধাদত্ত।
ওইদিন সার্কাসের মালিক থাইল্যান্ড থেকে নতুন ছ’খানা বাচ্চা বাঘ আনিয়েছিলেন। সুধাদত্তর বাবা মিহিদাত্তা একসঙ্গে বিভিন্ন সাইজের মোট বারোখানা লাট্টু ঘুরিয়ে সার্কাসে জাগলারি করতেন। লোকে বলত লাট্টু জেনা। বাঘ কেনার খরচা সামলাতে প্রথমেই লাট্টু জেনাকে ছাঁটাই করেছিলেন সার্কাস মালিক। আজ প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা।
আজ সরকারের চাপে পড়ে বাঘ-সিংহ বাদ। তাই আবার গ্রামে গ্রামে জাগলার খুঁজছে সার্কাস কোম্পানি। সুধাদত্তও খুঁজতে থাকে তিরিশ বছর পুরনো জীবনটা।
প্রস্তুতি
‘যে কোনও বিষয়ে নিজেকে আগে তৈরি করতে হয়। তা সে শিক্ষকতা বা অভিনয় যে বিষয়ই হোক না কেন।’
আমার কথা তখনও শেষ হয়নি অর্ণব বলে উঠেছিল, ‘জানো বাবার কাছে শুনেছি মাইকেল এঞ্জেলো লুকিয়ে লুকিয়ে মর্গে গিয়ে ডেডবডি কেটে দেখত মানুষের শিরা-উপশিরা কেমন হয়।’
অর্ঘ্য বলেছিল, ‘আমাদের শচীন দেববর্মনের কথাটাও বলো। একটা গানের সুর সাতদিন ধরে ভাবতেন।’
সুপ্রিয় বলল, ‘আমাদের উত্তমকুমারের একটা তোতলামি ছিল। ক্যামেরার সামনে জিভের আড়ষ্টতা কাটানোর জন্য রোজ সকালবেলা দু’ ঘণ্টা গীতাপাঠ করতেন।’
সোমাঞ্জন বরাবরের রসিক। বলে উঠল, ‘আমাদের জহর রায়ের কথাটা বল... ক্যামেরার সামনে ভানুর সাথে পাল্লা দেবে বলে শুটিংয়ের আগের রাতে পান্তুয়া দিয়ে বাংলা মদ খেয়ে নিজের ফ্রাসট্রেসনটা কাটাত।’
আমি বললাম, ‘আমিও সেই প্রস্তুতির কথাই বলছি। তবে অনুষ্ঠান হবে দেশ জুড়ে। প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক লাগবে মাইলের পর মাইল হাঁটবার জন্যে। তাই যেসব পরিযায়ী শ্রমিক মারা গেছে তাদের নিয়ে ভেবে কোনও লাভ নেই বরং যারা বেঁচে আছেন তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে। আফটার অল অনুষ্ঠানটা হল ভারতীয় গণতন্ত্রের শ্রাদ্ধ।’
No comments:
Post a Comment