বাক্‌ ১৪৫ ।। আমার সফর ১১ ।। দূর্বাদল মজুমদার

 

১৯৯৭-৯৮ এর ঝাড়খণ্ডে রাজনৈতিক সমীকরণ বাঁক নিচ্ছিল। ঝাড়খণ্ড মুক্তিমোর্চা তখন পিক ফর্মে। NDA এর শরীক। শিবু সোরেনের নেতৃত্বে বিহার ভেঙে ঝাড়খণ্ড হব হব করছে। মুক্তি মোর্চাকে বাইরে থেকে সাপোর্ট করছে পার্লামেন্টারী বামদল গুলি। বড় টাউন থেকে ছোট গঞ্জ, সব জায়গাতে একটাই আলোচনা, ঝাড়খণ্ড হবে। আরজেডি জেডিইউ এখানে ব্যাকফুটে চলে গেছে।কেবল শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ। গ্রামেগঞ্জে সিপিআই, ও জেএমএম এর রাজত্ব।   লিবারেশনের সামান্য কিছু অ্যাক্টিভিটি আছে। তাছাড়া প্রায় গোটা ঝাড়খণ্ডেই এমসিসি ও পার্টি ইউনিটির দখলে। পিপলস ওয়ার বা জনযুদ্ধ তখনো মাটি পাবার চেষ্টা করছে। 

 

  ঝাড়খণ্ডের নকশালপন্থী মুভমেন্ট কিন্তু অন্ধ্র-দণ্ডকারণ্যের মতো নয়। নব্বই এর দশকে বাহুবলী রাজনীতিই সর্বময় নিয়ন্তা। জোর যার মুলুক তার।এই সময় আরজেডি বা রাষ্ট্রীয় জনতা দলের কোন নেতা নির্বাচনী প্রচারে বেরোলে তার সাথে অন্ততঃ পঞ্চাশজন বন্দুকধারী বাহিনী কাঁধে রাইফেল নিয়ে জনগনকে অনুরোধ করত, দয়া করে ভোটটা আমাদের দেবেন।  

    তা সত্বেও জেএমএম জায়গা করে নিতে পেরেছিল এর জঙ্গল-পাহাড় অধ্যুষিত মালভূমি অঞ্চলের টিরেইন এবং বেশিরভাগ মানুষ আদিবাসী হওয়ার জন্য। 

   মাহাতো-কুড়মি, সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডারী, ভুমিজ, কাহালী, মাল-খেড়িয়া, মাল-পাহাড়িয়া, শবর, লোধা, ধাঙড়, ডোম প্রভৃতি জনজাতিরা জেএমএম কেই আপন মনে করেছিল জাতিসত্তার সেন্টিমেন্টকে সামনে রেখে। ক্রমশঃ ফেড-আউট হয়ে যাচ্ছিল আরজেডি জেডিইউ। স্পষ্টত ঝাড়খণ্ডী সমাজ দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল জনজাতি মানেই জেএমএম, আর  "বহিরাগত" এলিট সমাজ থাকবে অন্য দলে। আর বামদলগুলি থাকল শিল্পাঞ্চল ও খনিঅঞ্চলের ট্রেডইউনিয়নে সীমাবদ্ধ।   

  অথচ শিবু সোরেনের পথটা প্রথমদিকে মসৃণ ছিল না। বিনোদ বিহারি মাহাতো তৈরি করেন  "শিবাজী সমাজ" ১৯৬৭ সালে। আর শিবু সোরেনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় "সনত সান্তালী সমাজ" ১৯৬৯ সালে। তারপর আরো অনেকে মিলে তৈরি হয় "ঝাড়খণ্ড পার্টি"।    

  কিন্তু ভারতীয় রাজনৈতিক রৈখিকতায় যা হয় তাই হল। ভাঙতে শুরু হল ঝাড়খণ্ড পার্টি। 

এন ই হোরো, তৈরি করল একটা ঝাড়খণ্ড পার্টি। নরেন হাঁসদা তৈরি করল ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)। অল ইন্ডিয়া ঝাড়খণ্ডপার্টি তৈরি করল বেগুন সামরো। জাস্টিন রিচার্ড তৈরি করল "হুল ঝাড়খণ্ড পার্টি"। পরে শিবু সোরেনের সঙ্গে মিশে রিচার্ডের " হুল ঝাড়খণ্ড পার্টি" কিছুদিন চলেছিল। শেষমেশ বিনোদ বিহারি মাহাতোকে সভাপতি করে জেনারেল সেক্রেটারি শিবু সোরেন প্রতিষ্ঠা করেন " জে এম এম বা ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা "।এই মুক্তিমোর্চা গঠনে শিবু সোরনকে সাহায্য করেছিলেন কমিউনিস্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটির বিখ্যাত নেতা এ কে রায়। 

         ১৯৭১ এর সাধারণ নির্বাচনে জেএম এম সমীকরণ তৈরি করে দিল যে এইটিই আগামীদিনের সাধারণ পার্টি হয়ে উঠতে চলেছে।       

         এসব ঘটনা আমার কালীদার কাছে শোনা।কালী প্রসাদ মাহাতো। জোহরমুন্ডার গহন পাহাড় ডিঙিয়ে তিনি আমাকে পলাশবনীর হাট দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে হাটকালচার এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না। তবে জঙ্গলমহলে আজো আছে। আর ঝাড়খণ্ডে হাট মানেই সাজো সাজো রব। যেন পাহাড়তলীতে কেউ লাগাড়া বাজিয়ে   বিরাট উৎসবের ঘোষণা করে দিয়ে গেছে। বিশেষকরে কমবয়সী ছেলে মেয়েদের মধ্যে উদ্দীপনা প্রবল।সকাল থেকেই ছেলেরা সাইকেল মুছতে শুরু করে দেয় যতক্ষণ না তা ঝকঝকে দেখায়। পোঁটলা থেকে জামাকাপড় বের করে চাকুলিয়া সাবানে সেটাকে কেচে তার ধোপ উঠিয়ে তবে ছাড়ে। আইবুড়ো মেয়েরা জাহিরথানের মাটি মেখে চান করে, যাতে বোঙ্গা-ঠাকুরের সুদৃষ্টি তার উপর বর্তায়। মাথায় বুনো জুঁই ফুলের গন্ধওলা করঞ্জার তেল মাখে। খোঁপায় কুড়চিফুলের থোকা, তা না পেলে মোরগঝুঁটি ফুলই যথেষ্ট। যেন অরণ্যের রাজকন্যা চলেছে স্বয়ম্বরে। একসাথে অনেক সখীমিলে সমভিব্যাহারে বের হয়। তাদের এরওর গায়ে পড়ে সমবেত খিলখিল হাসি আর কলকাকলীতে মুখর হয়ে থাকে হাটে যাওয়ার বুনোপথ। 

  কত অল্পতেই সন্তুষ্ট ওরা। শাড়ীর খুটে হয়ত দু'পাঁচ টাকা দশটাকা বাঁধা, তাতেই কত কি কেনার খুশি। হাটফেেরতা মধুমাখা উজ্জ্বল সে সব কালো চকচকে মুখের ঢলোঢলো লাবন্য যেন ফেটে পড়ছে। সে সব মুখগুলোর প্রেমে পড়ে যেতাম যখন তখন। অনাস্বাদিত খুশির গুম্ গুম্ শব্দ হত বুকে। আমি তখন বাইশ। আমার রক্তে তাদের চকিত চাহনি মিশে যেত , হিলহিলে হাঁটার ছন্দে দূর পাহাড়ের গুহার রোমাঞ্চ জাগত । 

  

এখানের সুলাইপোসি হাটে নানারকম বুনো ফলমূল পাওয়া যেত। আমি তখনো আধাশহুরে পাবলিক, এসব ফলমূল চোখেই দেখিনি। এই হাটে এসে কালীদা আমাকে একটা একটা করে জিনিস চিনিয়ে দিল। আমরুলের পাতা শাক হিসেবে খাওয়া হয়, টকটক স্বাদ। পিয়ালের ছোট ফল, অম্লমধুর স্বাদ। খাম আলু, মেটে আলু, রাঙচা ইত্যাদি মূল-কন্দ। টকমিষ্টি ফলসা। বৈঁচি, তিরোল ইত্যাদি মিষ্টি ফল। সব পাওয়া যেত।

  বনমোরগ, খরগোস, গৃহপালিত নানাসাইজের মুরগী, ছাগল, ভেড়া, হালটানা গরু-মোষ, সব। হাটের একদিকে বড় বড় শাল মহুলের তলায় বসত সারি সারি মহুয়া আর হাঁড়িয়ার ঠেক। সামনে একটা করে ছোট গ্লাসে কেমন মদ, তা চাখবার ব্যবস্থা। বিভিন্ন দোকানের মদ  চাখতে চাখতেই নেশা হয়ে যেত। কার মদ কত বেশি মহুলে তৈরি আর কত পিওর তারই প্রতিযোগিতায় মত্ত দোকানীরা। এদিকে খদ্দের মদ কেনার আগেই চাখতে চাখতে কাদার কাঁচা তাল হয়ে মদের হাঁড়ির উপরই গড়িয়ে পড়ছে। আর মহিলা দোকানীরা তারস্বরে গাল পাড়ছে তাদের। হাসি কান্না গালাগালিতে জমে উঠছে হাট।    

     আমি তখনো বাইরের মানুষ, তার উপর অসিতদা'র কড়া নির্দেশ আছে, তাই কালীদা চাখতে লাগল আর আমি সেই মাদক গন্ধ নিতে নিতে আকূল হয়ে, উদাস হয়ে, বিবাগী হয়ে, আর যা যা হওয়া যায় সেসব হয়ে হাটের হট্টরোলের ভেতর ডুবে যেতে থাকলাম।                                                                                        

  অসিতদা'র সঙ্গে একবার এইরকমই হাটের মধ্যে কয়েকজনের সাথে আমরা পার্টিমিটিং করেছিলাম। 

আর একবার চিঙ্গানিয়ার হাটে, আমার তখন সেই মাসখানেক আসা হয়েছে গুড়াবান্ধায়, চোখের সামনে দুজন ষণ্ডা লোককে টাঙ্গি দিয়ে কুপিয়ে ফালাফালা করে দিতে দেখেছিলাম। মুখে গামছা বেঁধে এসেছিল জনা পনের লোক। তারা ছিল খেড়িয়া জাতির মানুষ। একটা টিলার আড়াল থেকে তারা হোহোহোহো শব্দে চিৎকার করে  বিশালাকায় তাবলা আর টাঙ্গি উঁচিয়ে দু'জন জোয়ান ছেলেকে ঘিরে ধরে। গোটা হাটকে স্তব্ধ করে দিয়ে ছেলে দুটোকে কেটে কুটে রেখে গেল তারা। 

  ছেলে দুটো ছিল গুড়াবান্ধার সিংহ ফ্যামিলির। বখাটে নেশাড়ু আর ভিনগাঁয়ের মেয়ে-বৌ দের দিকে নজর। অনেক কুকর্ম করলেও বারবার আইনের হাত ফস্কে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এবার হাত দিয়ে ফেলেছিল খেড়িয়া কমবয়সী মেয়ের গায়ে। এখানকার আদিবাসীরা বুঝতে পেরেছিল, থানা-পুলিশে গিয়ে কিছু হবে না। তারা দিন পনেরো ধরে রেইকি করছিল। তারপর সেদিন সুযোগ বুঝে কাজ সেরেদিল। 

  ফিরতি পথে বুঝেছিলাম গুড়াবান্ধা সেদিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল আর মনে মনে ধন্যবাদ দিয়েছিল লোকগুলোকে। এমনকি খেড়িয়াদের উপর পুলিশ যদি কোন স্টেপ নেয় তাহলে এলাকার আদিবাসীরা শালগিরার পথে যেতেও পিছপা হবে না এমনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল মাঝি-মাড়ওয়ারা। আর হাটের মানুষদের মধ্যে প্রত্যক্ষদর্শীরা যে কোনমতেই মুখ খুলবে না, এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিল পুলিশও।  

খেড়িয়াদের এই ঘটনাকে গুড়াবান্ধা এলাকার মানুষ সম্মানের দৃষ্টিতেই দেখেছিল সেদিন ।                      

 

        

ক্রমশঃ 

 

 

 

3 comments:

  1. ঝমঝকে টানটান । আমিই এখানে যেন তুমি । আহা ।

    ReplyDelete
  2. ঝমঝকে টানটান । আমিই এখানে যেন তুমি । আহা ।

    ReplyDelete
  3. ঝমঝকে টানটান । আমিই এখানে যেন তুমি । আহা ।

    ReplyDelete