বাক্‌ ১৪৫ ।। মৌসুমী ঘোষ


 

আরামকেদারা

 

ছোটোবেলায় যখনই কোনো বাড়িতে বেড়াতে যেতাম, দেখতাম একটা চেয়ার রাখা থাকত অতিথিদের জন্য। চেয়ারগুলো উনিশ-বিশ একই দেখতে। বসার জন্য একটা ঈষৎ অবতল চৌকো জায়গা, হেলান দেবার জন্য চৌকো ঠেকনা।

          কারও বাড়িতে চেয়ারটা হত কাঠের, কারও বাড়িতে বেতের অনেক পরে প্লাস্টিকের চেয়ার দেখেছি ঘরে ঘরে। সমাজকর্মী, শিল্পী বা নেতাগোছের কারও বাড়িতে একটা নয়, অনেক চেয়ার রাখা থাকত বাইরের ঘরে।

এক বান্ধবীর বাবা ডাক্তার ছিলেন বাইরের লোকেদের বসার জন্য ওদের বাড়িতে লম্বা সোফা ছিলপাড়ার এক জ্যেঠু মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, তাদের বাড়িতে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ড্রয়িংরুম ছিল। সেখানে গদি বসানো চেয়ার রাখা থাকত, জ্যেঠিমার পরিচিতদের বসার জন্য। কারণ জ্যেঠু তো বছরের বেশিরভাগ সময়ে সমুদ্রে ভেসে বেড়াতেন। গানের মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে মাটিতে গদি পাতা থাকত ছাত্র-ছাত্রীদের বসার জন্য।

আমাদের মফস্সলে তখন নতুন বাড়ি হলেই বারান্দা করা হতবারান্দায় কাঠের চেয়ারে নাইলনের ফিতে জড়ানো চেয়ার আর বেতের মোড়া থাকত বৃষ্টি এলে বা ছুটিতে কোথাও বেড়াতে যাবার সময় সেইসব চেয়ার আর মোড়া তুলে রাখা হত ঘরে।

আমি যেদিন প্রথম আমার প্রেমিকার বাড়ি গেছিলাম, দেখেছিলাম, সে বাগানে একটি চেয়ারে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আর তার চেয়ারের পাশে ছিল একটা ফাঁকা চেয়ার। চেয়ারটা রাখা হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। কারণ চেয়ারের নীচের ঘাসেরা বেশ উজ্জীবিত ছিল। চেয়ারটা ছিল হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ারচেয়ারটার একটা শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ছিল ঠিক আমার প্রেমিকার মতো। বেশ একটা গুরুগম্ভীর ব্যাপার ছিল চেয়ারটার মনে হচ্ছিল চেয়ারটা আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।

এরপর বহুবার ওদের বাড়ির বাগানে ওর সঙ্গে দেখা করেছি কিন্তু আর কখনও চেয়ারটা দেখিনি। তার বদলে কোনোদিন দেখেছি ও দোলনায় দুলছে, কোনোদিন দেখেছি ওদের পোষা কুকুরটা বসে আছে বাগানে চেয়ার পাতার জায়গায়টায়।

ওর জন্মদিনের দিন ফুল দিতে ঢুকলাম। আমাকে দেখে ও লাফিয়ে উঠলমিষ্টি আনতে ভিতরে গেল। আমি একটা ফাঁকা চেয়ার দেখলাম। চেয়ারটা আগের দিনের মতো ছিল না। একদম অন্যরকম ছিল। আমি চেয়ারটার কাছে গিয়ে ওর পিঠ ধরে ওকে তুলে এনে বসলাম। চেয়ারটা কোনো প্রতিবাদ করল না। আমিও বেশ আরাম বোধ করলাম। কারণ এমন আরামদায়ক আরামকেদারায় আমি এর আগে কখনও বসিনি। যতক্ষণ আমি সেটায় বসেছিলাম, সেই সময়টাই যথেষ্ট ছিল ওর সঙ্গে আমার নতুন সম্পর্ক গড়তে। সেদিনের মতো ফুল, মিষ্টি আর ভালোবাসার আদানপ্রদান হল।

বহু বছর পর, শেষ যেদিন প্রেমিকার বাড়ি গেলাম তখন করোনার জন্য দীর্ঘ লকডাউন উঠেছে সবেমাত্র। প্রেমিকা মুখে মাস্ক লাগিয়ে প্রথমদিনের মতো বাগানে একটা চেয়ারে বসে আছে। পাশে সেই চেয়ার। এদিন ওটাকে খুব হাস্যকর আর মেরুদণ্ডহীন লাগছিল। বেচারা চেয়ার! আজ ওকে বড্ড গুরুত্বহীন লাগছিল। আমার মনে হয় ও অপেক্ষা করছিল একটা মানুষের জন্য যে তার শরীরটাকে ভাঁজ করবে, ছড়িয়ে দেবে ওর দিকে এবং তার ওপর বসবে। আমার মনে হল আরামকেদারাটা ওর গঠনকে আরও একটু সাজিয়েগুজিয়ে যতটা সম্ভব আরামপ্রদ করে নিল। কিন্তু আমি বসলাম না, এমনকি গ্রাহ্যও করলাম না চেয়ারটাকে।

লকডাউনে পুরোনো কাজ হারিয়ে আমি এখন ওএলএক্স-এ চেয়ার কেনা-বেচার কাজ করি। যারা অতিথিদের জন্য নির্ধারিত বাড়ির উদ্‌বৃত্ত চেয়ারগুলো বেচতে চায় আমি সেগুলো কিনে নিই। তারপর রং করে চেয়ারগুলো কোয়ারেন্টিন সেন্টারে বিক্রি করে দিই। এখন কোয়ারেন্টিন সেন্টারগুলোয় পরিযায়ীদের যাতায়াত লেগেই আছে। ছোটোবেলা থেকে আমি বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে যে যে চেয়ারগুলোয় বসেছি তাদের সঙ্গে পুরোনো সম্পর্কের কথা ভাবলে আশা করাই যায় যে চেয়ারদের আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। কারণ বহুদিন অতিথিদের স্পর্শ না পাওয়া চেয়ারগুলো অবশেষে পরিযায়ীদের ক্লান্ত দেহের স্পর্শ পাচ্ছে

শেষ যেদিন ফোন পেয়ে হাজির হয়েছিলাম আমার প্রেমিকার বাড়ি, সেদিন হতবাক হয়ে গেছিলাম। কারণ আমি যে আরামকেদারাটায় একদিন বসে ভালোবাসা আদানপ্রদান করেছিলাম সেইটা আমার প্রেমিকা বেচতে চাইছে ওএলএক্স-এ! সে বলেছিল, ‘এই চেয়ারে বসবার জন্য এখন আর কেউই এ বাড়িতে আসবে না।’ কিন্তু শুধুমাত্র চেয়ারটার কথা ভেবে, আমি চেয়ারটা কিনলাম না। আমি বেরিয়ে গেট আটকানোর সময় দেখলাম, আমার প্রেমিকা ওটার পিঠ ধরে ঘরে নিয়ে গেল। ঠিক সেই সময় আমার ভিতর থেকে কেউ যেন বলে উঠল, ‘ও একটা সামান্য চেয়ার, তার বেশি কিছু না।’ আমার মনে হল প্রেমিকার হাতে ধরা চেয়ারটা ওর স্পর্শ পেয়ে সত্যিই খুব আনন্দ পাচ্ছেওকে তো ও ভালোবাসতপ্রেমিকা দরজা বন্ধ করে দিল। আমার মনে হল আমার প্রেমিকা আর সেই আরামকেদারা নিজেদের মধ্যে ব্যাপারটা ঠিকই বোঝাপড়া করে নেবে।

আমাদের জনপদে এখন আর কারও বাড়িতে কোনো অতিরিক্ত আরামকেদারা নেই আমি এখন সস্তা দামে প্রতিটি বাড়ির অতিরিক্ত শূন্যতাগুলো কিনে বেড়াই।

2 comments:

  1. বিষয়বৈচিত্র খুব অদ্ভুত। অন্য স্বাদের গল্প।

    ReplyDelete