বাক্‌ ১৪৫ ।। অভিরূপ মিত্র

 

সারমেয় সংবাদ

 

শিয়ালদহ থেকে এগারোটা চল্লিশে ছাড়ার কথা। কাঁকুড়গাছি জংশন পেরোচ্ছে যখন তখন মিনিটের কাঁটা সাতচল্লিশ ছুঁইছুঁই। আশঙ্কাটা দানা বাঁধছিল তখন থেকেই। এই যদি ঘ্যাতাতে ঘ্যাতাতে একটা বাজিয়ে দেয়, তাহলে বুড়োদা নির্ঘাত শাটার নামিয়ে দোতলায় উঠে যাবে। ডাকাডাকি করাও বিপদ। যেখানে রাত্রি হয় সেখানে কুকুরের ভয়। ওষুধের দালাল সম্বিৎ এটা দেখেছে বারবার। দক্ষিণ কলকাতার শেষ প্রান্তে অথবা ছাব্বিশ পরগনায় কোনো ডাক্তার রাত্রি দশটার পরে দেখা করতে বললে কী-ই বা করার থাকে আর?

          সেবার বেলামাসির বাড়ি থেকে ফিরতে গিয়েও রাত হয়েছিল। মানে শহরের হিসেবে নয়, তাদের পঞ্চায়েতের গলিতে। স্টেশন থেকে ব্রিজ পার হয়ে দু’-চাকায় পুবমুখো কুড়ি মিনিট। গলিতে ঢোকার মুখেই, পার্টি অফিসের পাশে উজিয়ে ওঠা বেআইনি সিঁড়ির তলা থেকে, তীব্র গতিতে বেরিয়ে এসে রাস্তা কেটে গেল কৃষ্ণকলি। ঘ্যাঁচ করে ডান হাতে চাপ। বাঁ পা মাটি ছুঁয়েই গেল মুচকে। পিছনে রূপকথা হুমড়ি খেয়ে খামচে ধরল কাঁধ। ঊর্ধ্বশ্বাসে উলটো ফুটে সেলুনের কার্নিশে উঠে তখন বিপদসীমা কতটা অতিক্রম করেছে তা মেপে নিচ্ছে মার্জার মসৃণতা। একে তো ফসকে গেল এমন শিকার, তার ওপর এমন পিলে চমকানিয়া ‘ক্যাঁচ’। দুয়ে মিলে তিনটে শিকারি বদলে ফেলল লক্ষ্য। বাইক ঘিরে হাড়হিম করা বুক্কন। কার্নিশে একজোড়া সবুজ চোখের ভয়ার্ত ও ভীতিপ্রদ ‘ম্যাঁও’। পিছনে রূপকথার অপৌরুষেয় চিৎকার। এমন কোনো ভয়ের পরিবেশ যে কোনো সময়েই ফিরে আসতে পারে, যখন দমদমেই নেমে গেল দু’টি মানুষ। বলা ভালো একজোড়া মানব-মানবী। বিধাননগর ঢোকার আগে থেকেই কথা কাটাকাটি শুরু হয়েছিল।

          ‘একদম গায়ে হাত দেবে না।’

          ‘কেন রে! তোর গায়ে হাত দেব না কেন?’

          ‘তুই-তোকারি করছ কেন?’

          ‘বেশ করছি!’

          প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকল। কেউ যদি ওঠে এই ভেবে থামল একটু। নামলও না কেউ। চড়তে থাকল উত্তেজনার পারদ। গাড়ির চাকার সঙ্গে গড়াতে থাকল ঝগড়ার তুষারবল। তিনজন এক জায়গায় বসে বিড়ি ফুঁকছে আর মাপছে ঘটনাটি। নীরবে। চারজন অ্যান্ড্রয়েড নিবিষ্ট। ভেন্ডরের কাটা কম্পার্টমেন্ট। আগে বোধহয় এগুলো লেডিজ কম্পার্টমেন্ট ছিল। অল্প ক’টা সিট। তার মধ্যেই একজন লম্বা সিটে শুয়ে এমন নাক ডাকাচ্ছে মনে হচ্ছে ট্রেন যেখানে চিরতরে থামবে সেটাই তার গন্তব্য।

          সহযাত্রী নিরীক্ষণ থেকে সম্বিৎ ফেরে, যখন হারাধনের আরও এক খসে গেল বেলঘরিয়াতে।

          রূপকথার শিক্ষিকা বোন এখানে আসে রোজ। বিয়ের দিন রাতে খোঁচা দিয়েছিল, ‘যা সব ঘটালেন গত একমাসে, দেখুন নিজের নামটা ফেরে কদ্দিনে।’

          কোণঠাসা পাত্র উত্তর দিয়েছিল দু’দিন পরে। কন্যাযাত্রী ফিরছে তখন। ‘এই যে বুলগেরিয়ার পাষণ্ড, ভালো থাকবেন!’

          কেউ উঠবে না আর? যে গতিতে প্যাভেলিয়নে ফিরছে পথিক তাতে মনে হচ্ছে মহাবিদ্রোহের সূতিকাগৃহে ঢুকতে ঢুকতেই মাঠ ফাঁকা হয়ে যাবে। তারপর পলতা, ইছাপুর, মায়ের-থান— একবার আগাম প্রণাম করে নেয় সম্বিৎ— এ যাত্রা রক্ষা করো মা। আগরপাড়ায় আরও এক! একে একে নিভিছে দেউটি। এবং মজার ব্যাপার যে স্টেশনটি সকালে ডাউনে গুঁজতে ও বিকালে আপে উগলাতে অভ্যস্ত, সেই সোদপুরে এই দিনবদলের কামরাতেও নামল না কেউ বরং উঠল একজোড়া।

          কলকল করতে করতে হাত ধরা ছেলেটি ধপ্‌ করে বসল ঘুমন্ত মানুষটার সামনের সিটে। সঙ্গিনীকে টেনে পাশে বসাবার আগেই হঠাৎ উপদ্রবে চমকে উঠল ঘুমন্ত লোকটি।

          সম্বিতের মনে পড়ল, ‘ভালো করে ঘুমোতে না পারলে বিপ্লব করা যায় না কোনোদিন।’ কে বলেছিল যেন? লোকটি একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে বসেছে।

একবার উলটোদিকে বসা মেয়েটিকে দেখে নিয়ে অদ্ভুত নমনীয়তায় আড়মোড়া ভাঙল। পশ্চাদগামী যুক্ত করযুগল থেকে মাজার নীচ পর্যন্ত একটা কাঠের লগের ধনুক। লুঙ্গির তটরেখার গভীর থেকে উঠে আসছে একটা কাটা দাগ। ঘন জঙ্গলে মানুষের চেরা পথের মতো। মেয়েটি জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ছেলেটি আর-একটু ঘন হয়ে এল।

‘জায়গা আছে তো, সরে বোসো না।’

জানলার ওপর একটা পোস্টার। গোপনে মদ ছাড়ান। সম্বিতের মনে হল, মদটা মুছে কেউ ‘বিষণ্ণতা’ কথাটা লিখে দিতে পারে না?

খড়দহে পিসে ছিল এক। রূপকথার। বিয়ের পরপর প্রথম এসে মনে হত বিষণ্ণতাবিলাস তাঁর অস্তিত্ব। ছেলেটি প্রতিষ্ঠিত। শালাজ যথেষ্ট সুন্দরী এবং গৃহকর্মনিপুণা। পিসেমশাই কেন্দ্রীয় সরকারের অবসরভাতা পান। তবু তাঁকে প্রণাম করে ‘কেমন আছেন?’ জিজ্ঞেস করায় উত্তর মিলেছিল, ‘বলো, কেন আছেন?’ রুপকথা ধমক লাগিয়েছিল জোর। আস্তে আস্তে বসার ঘর থেকে উঠে যায় তার বউদি।

‘তোমার কীসের অভাব বলো তো?’

সম্বিৎ-ও সংকুচিত। একে যুদ্ধজয় করার মতো সময় কাটিয়ে বিশেষ রূপে বহন করার দায়িত্ব তুলে নিতে হয়েছে ক’দিন আগে। দুই পরিবারে অশান্তি যখন বিদ্যুৎগর্ভ হয়ে উঠেছে, সম্বিতের সহকর্মী অমেয় বাগচী উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘সরষেদানার মতো একটু-একটু করে পিছিয়ে এসো।’

সম্বিতের কি দ্বিধা ছিল মনে?

অনেকেই জেনে গেছে এতদিনে। মেয়ের বাবাসুলভ লোকলজ্জার ভয়ে ঘাতসহ সময় পার করে তবে রূপকথা হল বাস্তব।

সম্বিতের সংকোচকে উপেক্ষা করেই পিসেমশাই বলে যান, ‘তোর পিসিটা চলে গেল আমারই জন্য। আমি ভাবছিলাম হোমিওপ্যাথিতেই কমবে। অনেকেই তো বলল...’

পিসেমশাই অনেকক্ষণ বকবক করেছিলেন সেদিন। রূপকথাও উঠে চলে যায় একসময়। সম্বিৎ জড়বৎ নীরব শ্রোতা। ভিতর থেকে ভেসে আসছে প্রমীলা কণ্ঠে হাসাহাসি। পিসতুতো শালাটি ফিরবে কখন?

‘জামাই, তুমি আত্মহত্যা নিয়ে কখনও পড়েছ কিছু?’

এ কী বেকায়দা প্রশ্ন রে বাবা!

আমতা-আমতা করে বলে, ‘না, মানে সেরকম কিছু...’

‘আমি পড়লাম একটা গল্পে একটা চরিত্র বলছে, নিজেকে অকথিত নির্যাতনে নিয়ে যেতে। উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে, রেললাইনে, ইঁদুরের বিষে, সিলিং থেকে ঝুলে, লক্ষ্যনির্দিষ্টতা আছে, কিছু মাধ্যমের উপভোগ্যতা নেই। এমন যন্ত্রণা, যাতে এই শরীর— জল, মাটি, বাতাস দিয়ে গড়ে তোলা ঈশ্বরের জীবন্ত মন্দির— বুঝতে পারে, চারপাশে যা হয়ে চলেছে, তাতে তার সরাসরি দায়িত্ব না থাকলেও, সে দায় এড়িয়ে যেতে পারে না।’

কথার তোড়ে ঘোর লেগে যায় সম্বিতের। আঁকাবাঁকা স্মৃতির পথে পড়ে আছে শব্দের কঙ্কাল। ‘শুধু পুত্র-পুত্রবধূর ভালোবাসা নয়, শুধু ওদের মায়ের হারিয়ে যাওয়া উষ্ণতা নয়, এই কাঠামোর হাড়ে-মজ্জে আছে সুপ্ত ঘৃণা ও গুপ্ত জিঘাংসা। তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় আত্মবিম্ব। অথবা সে নিজেই, আপন হতে বাহির হয়ে দাঁড়া—’

‘ধর-ধর-ধর—’ আচমকা চিৎকারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সম্বিৎ নিজেকে আবিষ্কার করে দু’ সারি সিটের মাঝে, ফুটবোর্ডে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা অবস্থায়।

‘কি দাদা, ঘুমোচ্ছিলেন নাকি?’

‘টেনে উঠেছে বোধহয়!’

অনেকদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় উঠেছিল একবার। তিন বন্ধু মিলে। দু’জনে আউট। তৃতীয়জন পাবলিকের গালাগাল খেতে খেতে আর বমি ধুতে ধুতে ফিরেছিল। এখনও গুলোচ্ছে গা-টা। একজন হাটুরে গোছের এগিয়ে এসে টেনে তোলে। দু’দিকে প্ল্যাটফর্ম— ট্রেনটা কচ্ছপ-মন্থরতায় ছেড়ে যাচ্ছে ইস্টিশন। ঢুলুঢুলু চোখেই জিজ্ঞেস করে, ‘ব্যারাকপুর ছাড়ল?’

‘কুথায় ব্যারাকপুর? কল্যাণী আসছে!’ লোকটা সম্বিতকে সিটে বসিয়ে লাল-কালো দাঁত বার করে হাসে।

‘হালিসহর চলে গেল!’ হাহাকারের মতো শোনায় সম্বিতের কণ্ঠস্বর। এলোপাথাড়ি অ্যাড্রিনালিন ধেয়ে যায় গেটের দিকে। হারাধনের পড়ে থাকা দু’-তিনটি ছেলে ছুটে আসে অথবা হাঁহাঁ করে বারণ করতে চায়। একটা উদ্‌ভ্রান্ত মানুষ আছড়ে পড়ে প্রলম্বিত প্ল্যাটফর্মে শ্বাপদকুণ্ডলীর ওপর।

প্রথম গর্জনটা হল সেই ফিজিক্স স্যারের মতো যার বাড়ির প্র্যাকটিকাল ক্লাসে ভর্তি হয়নি বলে উচ্চমাধ্যমিকে লেটার পাওয়া হল না সম্বিতের। ডান পা পড়তেই বাঁদিকের থাবা আঁচড়েছিল আক্রান্ত রূপকথার ক্ষিপ্রতায়। ততক্ষণে যুধিষ্ঠিরের বন্ধু হয়েছে সবান্ধব। প্রথম প্রেমিকাকে চুম্বন করেছিল যে বন্ধু, তার ওপর কোনো এক বেতালা হোলিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যে হিংস্রতায়, তেমনি আক্রমণের মুখে পড়ে সম্বিৎ।

হাঁকপাক করে কোনোক্রমে দু’ নম্বর প্ল্যাটফর্মের পুবদিকে একটা লাফ। দূর থেকে চিৎকার করে উঠল কেউ। ওরাও লাফিয়ে নেমেছে। অন্ধকারে জ্বলছে চোখ। আবার ছুট। হোঁচট খেয়ে পড়ে নর্দমায়। আচমকা আলোড়নে বিরক্ত হয়ে জিভ দেখাল একটা ঢোঁড়া সাপ।

যন্ত্রগতিতে পথপিষ্ট কুকুরদের বাড়তি আয়ু শুষে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালায় সম্বিৎ।

No comments:

Post a Comment