কিছু কথা, কিছু অভিমান
এক
কলসের মুখের যে ঢাকাটি, অভিমান, সেটি সরিয়ে নিলেই
ভিতরে পেয়ে যাবে স্নেহ, টলটলে, স্বচ্ছ।
কিন্তু, তুমি তো খাওনি গড়িয়ে, এমনকি, জলটুকুও, কোনোদিন।
কলস কী ভাবে ধরতে হয়, কাত করে
কীভাবে গড়িয়ে নিতে হয়, তরল, ভিতরের, সবটুকু,
তুমি কি জানো তা?
জানো না তো!
ঢাকাটুকু সরিয়ে নাও।
উঁকি মেরে দ্যাখো, ভিতরে, কলসের।
যা আছে, যেটুকু আছে, নাও গড়িয়ে নাও।
ঢাকাটা সরিয়ে নিও, প্রথমেই, ভুলো না।
দুই
এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ এভাবে পিছিয়ে এলে
অভিমান হয়, পথের, যে সামনে পড়ে আছে।
হয়তো সে সাজিয়ে রেখেছিল রহস্য বা ম্যাজিক, কোনো এক বাঁকে।
হয়তো রেখেছিল, সাজিয়ে, ওইই একপাশে, খুদে খুদে তারাফুলগুলো।
বা, ঝরিয়ে
রেখেছিল অমলতাস,
পথের ওপরেই।
তুমি পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবে, সে হলুদ পথ ধরে ঠিক, ভেবে রেখেছিল।
এভাবে পিছিয়ে আসতে নেই।
পথেরও তো দরকার হয়, সঠিক পথিকের!
এই যে এতো ধুলো দুই পদতলে, এই
যে চরৈবেতি
এতকাল,—
পথেরও তো থাকে, ভালোবাসাবাসি!
তিন
হবেই তো, যেতে।
চলে তো যেতেই হবে, ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়।
দুহাতের মধ্যে তাই রেখে দাও স্মৃতিচিহ্ন, আবেগ, লড়াই।
যাবে যখন, ছড়াতে ছড়াতে যেও, পথে।
চলে যাবে, চিহ্ন রেখে যাবে না ?
ফিরবে না বুঝি আর, এইপথে?
চার
প্রতিটি বেহালার নাম, আসলে, মনখারাপ।
তাতে টান দিয়ে যায় যে ছড়, তার নাম অভিমান।
সরোদ মানে, জেনো, প্রতিটি নিঃসঙ্গ মানুষ।
নিঃসঙ্গ মানুষেরা বেজে উঠলেই, চরাচর হয়ে ওঠে শুদ্ধ-সারঙ,
আর, আকাশের নাম হয়, সিন্ধুভৈরবী।
পাঁচ
যে জীবন চলমান, তাকে এতো তুচ্ছ ভাবো তুমি?
মৃত্তিকা ছুঁয়েছে যে , সে রেখেছে তোমারো জন্য ভুমি।
তাকে তুমি যা দেখেছ, সে আসলে সেরকম নয়,
আবহমান কাল সেই
ঠেলে সরিয়েছে ভয়
তোমার পথটি থেকে, সেই জুড়ে দিয়েছিল সেতু
একাল পেরিয়ে তুমি ওকালে পৌঁছবে, সেই হেতু।
চলমান জীবনকে কোরো না তুচ্ছ তুমি আর;
মিলে যাও, মিশে যাও,
এপার ওপার।
ছয়
কী তবে চাইছ, বলো?
এই বয়ে চলা, নিরবধি,
না কি, অখন্ড স্তব্ধতা এই?
বয়ে যেতে যেতে তুমি ছুঁয়ে দিতে পারো
অনেক মানুষ আর হরেক মানুষ
আর কিছু কিছু মন।
সে কি বড় সুন্দর নয়?
কিন্তু
স্তব্ধতা দিয়ে তুমি ছুঁতে চাও কাকে?
বুঝি অন্ধকার ছুঁতে চাও?
নীরবতা সঙ্গে নিয়ে ছুঁতে পারো, তাকে,
গর্জন হৃদয়ে ধরেছে , সেই সমুদ্রকে?
সাত
পুরো কথা শুনে নাও, যাবার আগে।
এই যে দেখছ, শুধু মাটি, তালমাত্র,
একে আমি ফেলব চাকায়, আর
ঘোরাবো, ঘোরাবো, ঘোরাবো খুব।
তার সাথে সাথে, ব্যবহার করব হাত, এই যে,
দুই হাত আমার, আর
এই নাও, দ্যাখো, পাত্রটি, কেমন উঠল গড়ে!
এরপর দু একটি খোদাইকর্ম বাকি থাকে।
বাকি থাকে ফেলে রাখা, রৌদ্রে।
আর আগুনে পোড়ানো, পোড়ানো, পোড়ানো– রৌদ্রে শুকিয়ে ওঠার পর।
এইবার ঠিকঠাক পাকা হল মাটি।
এরপর রঙ করি যদি, ইচ্ছামত, বসে দেখে যেও।
তার আগে যেও না।
দুয়েক কথায় কি কথা পূর্ণ হয়?
মাখতে হয়, ঘোরাতে হয়, পোড়াতে হয়...
তারও পর, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কিছু কারুকাজ আর রঙের প্রলেপ দেওয়া,
বাকি থাকে।
আট
এক জানলা থেকে আরেক জানলা যেতে যেতে
যেতে যেতেই
ঝরে যাচ্ছে জল, ফাঁক গলে, আঙুলের।
এই জল, যা ধারণ করেছিল, তোমাকে, আদিতে।
এই জল পড়ে যাচ্ছে, করতল থেকে।
তাও তুমি চাইছো না, বুঝতে, ওই
ফাঁকগুলি, দু আঙুলের মধ্যবর্তী, সেইই সৃষ্টি করেছে,
যে সৃষ্টি করেছে তোমাকে, জলকে, ও তোমার আঙুলদেরকেও।
এক জানলা থেকে আরেক জানলা,
দৌড়ে যাও–
হিসেবি দৌড়,
শূণ্য না হয়ে যায়, করপুট...
নয়
এত যে কড় গুনে গুনে মেপেছ, ছন্দ, এতকাল ধরে,
হিসেব কষেছ অমিত্রাক্ষর, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্তের..
পেরেছ মেলাতে, জীবন?
তবে আর কার কাছে, আর কেনই বা দেবে উত্তর–
কেন আজ লিখছ এতো মাত্রাহীন, ছন্দ হীন
শব্দ ও অক্ষর কিছু?
কাকেই বা চাও, বোঝাতে
জীবন শুধু সমষ্টি,
কিছু ঘটনার,
এ বই তো কিছু নয়, কিচ্ছুটি নয়!
কার কাছে দায়বদ্ধ তুমি,
কে করে তলব, কৈফিয়ত?
তাকে বলে দাও,
কোন ছন্দ নেই, রাতের, যে নির্ঘুম।
দশ
ছেড়ে যাচ্ছি সব
ধীরে ধীরে, খুব ধীরে
যাতে নিজেই বুঝতে না পারি
যেভাবে বোঝা যায়নি সন্তানের বড় হওয়া
যেভাবে বোঝা যায়নি, একরত্তি অ্যালামন্ডা কবে
ঘিরে ফেলল সমস্ত সীমানা প্রাচীর
সেভাবেই ধীরে, খুব ধীরে...
গুছিয়ে রাখছি সব
হিসেবের খাতা, জরুরী ফোন নম্বর
হঠাৎ গ্যাস ফুরিয়ে যায় যদি, যদি মাঝরাতে ভেঙে যায় বাথরুমের কল,
হঠাৎ বাজার দরকার হলে কাকে ডাকবে,
ছাদ দিয়ে জল পড়লে মিস্ত্রী ডাকবে কাকে,
সব লিখে রেখে যাব।
ধীরে ধীরে গুছিয়ে রাখছি সব।
হুট করে চলে গিয়ে অসুবিধা তৈরী করব না
আমি তো জানি, কত অসুবিধা হয়।
সেই যে দুপুরবেলা, হঠাৎ একটা ফোন করে চলে গেলে,
কিছু তো গোছানো ছিল না, মনটাও না।
খুব অসুবিধা হয়েছিল
ঝড়ের মুখে খড়কুটোর মতো উড়ে যেতে যেতে এলোমেলো হয়ে গেছিলাম।
ঝড় সামলে ফিরে আসতে সময় লেগেছিল।
ধীরে ধীরে ফিরে এসেছিলাম
ধীরে ধীরে গুছিয়ে নিয়েছিলাম, নিজেকে।
ধীরে ধীরেই চলে যাব।
সব গুছিয়ে রেখো যাব।
অসুবিধা হবে না তোমার।
জানি তো, কত অসুবিধা হয়...
অদ্ভুত দর্শন আপনার কবিতায়। ভালো লাগল
ReplyDelete