কালো রাস্তায় সাদা ঘোড়া
থানায় বিক্ষোভ। ক’দিন ধরে নাগাড়ে। বিক্ষোভ টোটো, অটো, দু’-চাকা, চার-চাকার মালিকদের। বিক্ষোভ অঞ্চলের লোকেদের। টাকা (ঘুষ) না দিলে কোনও কাজ করতে চায় না থানা। দু’-একবার এ-বিষয়ে বড়বাবুর সঙ্গে মিটিং করেও কোনও সুরাহা হয়নি। এবার বিক্ষোভ, থানা ঘেরাও।
পুলিশের ছড়াছড়ি। থানার বাইরে স্লোগান, ঘুষ আমরা দেব না, দেব না। ঘুষ না দিলে অকারণে হয়রানি করা চলবে না, চলবে না। ইত্যাদি।
রিকশাচালক পাঁচুদা নিজের রিকশা নিয়ে থানার দিকে আসছিল। মাঝরাস্তায় দু’-একবার ভেবেওছিল আজ নয় কাল যাবে। থানায় দু’-তিনদিন ধরে একঘণ্টা করে রোজ বিক্ষোভ চলছে। ক’দিন এমন চলবে বোঝা যাচ্ছে না। তাই আজ সকালে ঠিক করে রেখেছিল, থানায় যাবেই। তিনদিন তার ঘুম নেই। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। দাঁতের ফাঁকে খাবারের কণা আটকে গেলে, অস্বস্তিবশত জিভের ডগা বারবার সেখানেই যেমন চলে গিয়ে অস্বস্তি বাড়ায়। তেমনই হচ্ছিল পাঁচুদার।
তার বাড়িতে নিজের বউ, ছেলে, ছেলের বউ, মায় চোদ্দো বছরের নাতিটা পর্যন্ত ভাল নয়। তাই অগত্যা থানা।
এখন বিক্ষোভ অনেকটা থিতিয়ে এসেছে। বন্ধ হয়েছে স্লোগান। অনেকেই উলটোদিকে হাঁটার তোড়জোড় করছে। বাইরের ছড়ানো ছিটানো পুলিশেরা ঢুকছে ভেতরে।
থানার গা ঘেঁষে রিকশা দাঁড় করাল পাঁচুদা। সেখান থেকেই শুনতে পাচ্ছে, পুলিশ নাকি লিগ্যাল মার্ডারার। ঘুষ ছাড়া কাজ করে না।
শাল্লা! লঙ্কায় ঢুকে দ্যাখ। রাবণ না হয়ে পারিস নাকি? আজকের দিনে এক্সট্রা পয়সা কে ছাড়ে?
আন্দোলন! গাঁড়ে ঢুকিয়ে দেব।
মেজোবাবুর চোখ পড়তেই বললেন, কে তুই?
—পাঁচু স্যার! পাঁচু কর্মকার।
—কী চাই?
—কিছু না।
—তবে?
—এটা দিতে এসেছি।
—এটা কী?
—টাকা।
—কী করেছিস?
—কিছু না।
—তাহলে টাকা কেন?
—ঘুমাতে পারছি না।
—কেন ঘুমোতে পারছিস না?
—এগুলোর জন্য।
—এগুলোর জন্য!
—হ্যাঁ। স্যার।
—কী করিস?
—রেক্সা চালাই।
—তা থানায়...
মেজোবাবুর কথা শেষ হওয়ার আগেই পাঁচুদা বলে উঠল, সোমবার রাত তিনটেয় প্যাসেঞ্জারকে ফাস ট্রেন ধয়রে আসার সময় পানিট্যাঙ্কির রাস্তায় এমন চটের ব্যাগে মোড়া অবস্থায় পড়েছিল। বাড়িতে এসে লুক্কে খুলেছিলাম। দেখি দেদার টাকা। বাড়ির লোকেরা ভাল নয়। তাই গাড়ির সিটের নীচে ভেতরে তালা দিয়ে রেখেছিলাম। চোখে ঘুম নেই। মনে স্বস্তি নেই। কাউকে কিছু বলতে পারিনি। আপনারা তো আমাদের মা-বাপ। আপনারাই এগুলো রাখুন।
পাঁচুদা আর দাঁড়াল না। মনে আনন্দ। আজ থেকে সে আবার ঘুমোতে পারবে।
আঘাত
তেত্রিশ বছর পর আমি হব একশো।
জীবনে কত রকমের আঘাত পেয়েছি, তা থেকে প্রচুর অভিজ্ঞতা। এখন আর দুঃখ, ব্যথা-বেদনা অনুভব করি না। উপভোগ করি। শুধুমাত্র একটা আঘাত মনে পড়লেই বলে উঠি, মা, মাগো!
ক্লাস ফোরে পড়তাম। অনেকগুলো ভাইবোন আমরা। বাবা-মার চেয়েও বড়দা বড়। বড়দার বুদ্ধি, বিচক্ষণতা অতুলনীয়। যেমন শাসন, তেমনই ভালবাসা, মমতা। বাড়িতে বড়দার কথাই শেষ কথা।
সেদিন রাতে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মারামারি হয়। দাদা কান ধরে আমার দু’গালে দিল ঠাস ঠাস চড়। কেঁদে ছিলাম, রাগও হয়েছিল ভেতরে।
তখন রাত আটটার মধ্যে খাওয়া আর শুয়ে পড়া। ভোর ভোর উঠে পড়া। রান্নাঘরে আমি না যাওয়ায় মা আমার নাম ধরে ডাকতেও আমি সাড়া দিইনি। একটু ঝাঁঝিয়ে বলেছিলাম, খাব না।
শুনতে পেয়েছিল বড়দা। চড়া গলায় বলে দিল, থাক। না খায়, না খাবে। সকলে খেয়ে শুয়ে পড়। মা, আপনিও খেয়ে শুয়ে পড়ুন। আর একবারও ডাকবেন না।
গরমকাল। দরজাওয়ালা মশারির ভেতর মাথায় বালিশ, ঘরের মেঝেতে পাশাপাশি কয়েকজন আমরা ভাইবোন। মিনমিনে হ্যারিকেনের আলো। একবার ভাবলাম, নিজেই চলে যাই। পরক্ষণেই রাগের বাধা। বেশ কয়েকবার দোনোমনো করতে করতে রান্নাঘরে। পেটে প্রচণ্ড খিদে। গজগজ করতে করতে মাকে বললাম, আজ খেয়ে নিচ্ছি। লেলো অমন করলে আবার, আমি খাব না।
এবারও শুনতে পেয়েছিল বড়দা। বলে দিল, না। তোকে খেতে হবে না। যা শুয়ে পড়।
কাঁচুমাচু মুখে ফিরে এলাম। শুয়ে পড়লাম ঘরে। জানতাম, চুপিচুপি ডাকবেন মা। আমি না খেলে মা-ও খাবেন না। শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছি রান্নাঘরের দিকে। একবার ডাকলেই যাব।
হ্যারিকেন নিয়ে মা ঢুকলেন রান্নাঘরে।
টানটান হয়ে আছি। ডাকলেন না মা। খেতে যতক্ষণ সময় লাগে, সেসময় পার করে বেরিয়ে এলেন মা। পরপর সবাই অকাতরে ঘুমাচ্ছে। আমার চোখে জল। শেষ পর্যন্ত মা! খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লেন! আমার মধ্যে কেমন যেন হতে লাগল।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই।
সকলের আগে ঘুম ভেঙেছিল আমার। চুপিসাড়ে সয়ে যাওয়া অন্ধকার নিয়ে প্রথমেই রান্নাঘরে। আবছায়াতেই দেখলাম, ঢাকা দেওয়া থালায় আমার রুটি-তরকারি। একটু পাশেই ঢাকা দেওয়া আর-একটা থালা। নিঃশব্দে খুললাম। চিত হয়ে তিনটে রুটি। তরকারি নেই। বহুদিন তরকারি পায় না কে?
ঘরে শুয়েই নিঃশব্দে ককিয়ে স্বগক্তোতি করলাম, মা, মাগো!
এই বয়সে
লোকটাকে সকলে এইভাবে চেনে— টাকমাথা, পরনে সাদামাটা ধুতি-পাঞ্জাবি, পায়ে স্যানডাক বা ওই জাতীয় চপ্পল। হাতে থাকে একটা ঝোলা। ঝোলায় কিছু না কিছু থাকে। তাই বোধহয় ঝোলাটায় টান থাকে নীচের দিকে।
প্রায় রোজ সন্ধ্যার দিকে বঙ্গ বিদ্যালয়ের পাশে থাকা পিচরাস্তার গলি দিয়ে দক্ষিণমুখোয় যায়। হয়তো ওটাই তার বাড়ি ফেরার রাস্তা।
রাস্তার বাঁকের মুখে একটা পুরনো গাছের গুঁড়ি। ক’টা ছেলে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। আড্ডা দেয়। উলটোদিকে তাদের সাইকেল, বাইক।
ছেলেগুলো ভাল নয়। সন্ধে নামলে মেয়েরা ওই রাস্তা এড়িয়ে চলে। বড্ড বাজে বাজে টোন টিটকিরি ধেয়ে আসে তাদের উদ্দেশ্যে। দু’-চারবার ঝামেলা হয়েছে, হয়েছে থানাপুলিশ। কাজ হয়নি। ওরা রাজনৈতিক দলের ছেলে।
লোকটা আজও হেঁটে যাচ্ছিল দক্ষিণমুখো। সামনে একটা মেয়ে-বউ। হয়তো মা-মেয়ে।
লোকটার কানে এল, দুটোই চলবে। একেবারে ডাঁসা। সাইজ দেখেছিস, এক্কেবারে ফজলি আম।
কলা দিয়ে যা লাগবে না।
আর-একটা ছেলে মুখ দিয়ে একটা বিশ্রী চটাস করে আওয়াজ করল।
বউ-মেয়েটা মাথা নীচু করে পা চালিয়ে এগিয়ে চলল।
থমকে দাঁড়াল লোকটা। গুঁড়িতে বসে থাকা একটা ছেলের জামার কলারটা খপ করে ধরে এক হ্যাঁচকা টান। টাল সামলে দাঁড়াতেই তার গালে সপাটে এক চড়। এবার গলার স্বর চড়িয়ে বলল, কেউ কিছু বলে না না! বাড়িতে মা-বোন-মাসি-পিসি কেউই নেই? তোর বাবা-মা জানে তাঁরা এমন জানোয়ারের জন্ম দিয়েছেন?
আচমকা এমন অদ্ভুত ঘটনায় ছেলেগুলো একটু হকচকিয়ে গেল।
সংবিৎ ফিরে পেতেই লোকটাকে রাস্তায় ফেলে শুরু করল বেধড়ক মারধর। ছিটকে গেল ব্যাগে থাকা স্লাইস পাঁউরুটি, বিস্কুট। চশমাটা পায়ে মাড়িয়ে ভেঙে দিল একজন। চটিজোড়া দু’দিকে, ছিঁড়েছে পাঞ্জাবি, এলোমেলো ধুতি।
চোখ মেলে তাকাল লোকটা।
হসপিটাল।
কম্পাউন্ডার ছেলেটি বেশ সাবধানে ব্যান্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে বলল, এই বয়সে...
কথা শেষ হওয়ার আগেই লোকটা বলল, হয়েছে?
লোকটার পাশে কয়েকটা ছেলে। তাদের একজন ডাক্তারবাবুর পাশেই।
ডাক্তারবাবু প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বললেন, এই বয়সে এসবের মধ্যে আপনাকে মানায়?
ছেলেগুলোর সঙ্গে থানায়।
সব শুনলেন টেবিল ডিউটি অফিসার। ডায়েরি লিখতে লিখতে তাকালেন লোকটার দিকে। বললেন, এই বয়সে এসবের দরকার ছিল?
রাতে বাড়িতে এলেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর। সব শুনলেন। বললেন, কী দরকার ছিল এই বয়সে...
কাছের কলোনি কমিটির সেক্রেটারি কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। বললেন, এই বয়সে...
কথা শেষ হওয়ার আগেই লোকটা বলে উঠল, আমার যাওয়া উচিত হয়নি।
পরের দিন সকাল থেকে নানান লোকজন। তাদের নানান কৌতূহল। জিজ্ঞাসা।
সবশেষে সকলের এক মত, এই বয়সে...
বেলা বাড়তে ছেলে-ছেলের বউ বলল, আপনি যাই বলুন বাবা...
ওদের কথা থামিয়ে দিয়ে বলল, জানি এই বয়সে...
প্রথম দুটো গল্পে আপনি আপনার জাত চিনিয়ে দিয়েছেন দাদা।
ReplyDelete