বাক্‌ ১৪৫ ।। সৌমেন ঘোষ

 

চল্লিশ

 

‘এবারও তোমার প্রোমোশনটা করানো গেল না, আশিস।’

          ‘আচ্ছা স্যার’

          স্যারের মনে পড়ে প্রথম বছর প্রতিবাদ করেছিল আশিস। দ্বিতীয় বছর জিগ্যেস করেছিল ‘কেন স্যার?’ তৃতীয় বছর নিরাসক্ত ‘আচ্ছা স্যার’।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন স্যার। ফি-বছর বাৎসরিক মূল্যায়ন ব্যাপারটা বেদনাদায়ক। সিনেমায় একটা হিরো পছন্দ করলে, বিপরীতে একটা ভিলেনও থাকে। এখানে একটা হিরোর পাশে পঞ্চাশটা আমজনতা। হিরোও না, ভিলেনও না, সাধারণ মধ্যবিত্ততা। হিসেবের এই তুল্যমূল্যহীনতা ব্যাপারটাকে জটিল করে দ্যায়।

আশিস কিন্তু সত্যকে মেনে নিয়েছে, সহজে।

আশিস সেই সময়ের ছাত্র, যখন স্কুলশিক্ষকের মারার চল ছিল। যে প্রশ্নের উত্তর জানা থাকত না, তার উত্তর আসত সপাট চড়ে। রামজীবনবাবু ওরকম একটা চড়ের পর রাগত গলায় শাসিয়েছিলেন, ‘স্যারের মুখে মুখে তর্ক করতে নেই।’ বারো বছরের আশিস ধরা গলায় বলেছিল, ‘আচ্ছা স্যার।’

          স্কুল আনুগত্য শেখায়, আর জীবন অসামঞ্জস্য।

 

 

 

 

ষাট

 

অবসর ব্যাপারটা মেনে নেওয়া কঠিন। রোগ, জ্বর, জ্বালা কিছুই নেই। শরীরে উদ্যমেরও কমতি নেই। আরে বাবা, বিজ্ঞানের কল্যাণে প্রতি বছর মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে তো, নাকি! তবে অবসরের বয়স স্থিতিজাড্যে ভুগছে কেন!

তিরিশ বছরের কর্মোদ্যমী জীবন। হঠাৎ করে হতোদ্যম হওয়ার ঝামেলা অনেক। মাসিক আয়টা ভগ্নাংশ হতেই, চায়ের সময়টাও হেরফের হতে থাকে। আর নিজের প্রতিবাদের ডেসিবেলের মাত্রাটাও নিম্নগামী। কাজের অবসর যেন একটা আনুষ্ঠানিক বার্ধক্য ঘোষণা।

সরকারি চাকরির শ্রম বিভাজনের কলে, একই কর্মবিভাগে দীর্ঘদিন কাজের কারণে, অন্য চাকুরিযোগ্যতা হারিয়েছে। শেখা হয়নি তেমন কিছুই, চেনা ছকের বাইরে।

শেষ রাতে মাফলারটা কানে-মাথায় জুতসই করে বেঁধে নেন। তিনটে কুড়ির লোকালের পেপার ধরতে হবে। আপাতত কুড়িটা বাড়ি। বয়সের সঙ্গে বাড়িও বাড়াতেই হবে।

 

 

 

 

আশি

 

সময়ের থমকানিটা বেশ উপভোগই করেন। আরামকেদারাটা আরামদায়ক না হলেও একটা দৃষ্টিপথ খুলে দেয় সামনে। ঘাড়ের নড়াচড়া প্লাস-মাইনাস দশ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ হওয়ায় দৃষ্টিকোণও সীমাবদ্ধ। কিন্তু তাতেও কিছু এসে যায় না আশিসের। যাওয়া-আসার সময় গেছে। মানসিক আর শারীরিক স্থবিরতা একটা শান্তি এনে দেয়। নো ফিয়ার অফ মিসিং আউট, এনি মোর

          বিগত দশ বছরের প্রত্যেক দিনের খবরের কাগজ পড়েও আন্দাজ করা যায় না পরের দশ দিনে কী হবে। তাই খবরের কাগজ পড়াও ছেড়েছেন ইদানীং। তাই কি? নাকি চোখের দোষের জন্য, ঠিক মনে করতে পারেন না।

          এই কিছুতেই কিছু না এসে যাওয়া জীবনে বড় হাসি পায়, ছেলে-বউমাদের কাণ্ডকারখানা দেখে। একা-একাই খানিকটা হেসে নেন আশিস। কিন্তু ছেলে-বউমা তো টেক্সাসে থাকে। বয়সের কী পরিহাস, নিজেরই চল্লিশ বছর দেখে নিজেই হাসছিলেন এতক্ষণ। হবেই বা। কী-ই বা এসে যায়! ডাক্তারটা আবার ছেলের বন্ধু। ডেথ সার্টিফিকেটে নিঃসঙ্গতা লিখবে না নিশ্চয়ই। ওদের অনেক বিকল্প শব্দবন্ধ আছে। লিখলেও, কী-ই বা যাবে আসবে!

No comments:

Post a Comment