অনুপম বলছি
সাহিত্যিক যখন লিখছেন, শিল্পী যখন আঁকছেন, বলা হচ্ছে- ‘এ জিনিস মানুষ নিতে পারবে না।’ প্রশ্ন হল- ‘কোন মানুষ নিতে পারবে না?’ অথবা বলা হচ্ছে- ‘এই হল মানুষের জন্য সৃষ্টি।’ প্রশ্ন হল- ‘কোন মানুষের জন্য সৃষ্টি হল সেটা?’ যখন সদ্য লিখতে শুরু করেছি, আমার কবিতা পড়ে আমার শহরের একজন বয়স্ক কম্যুনিস্ট নেতা বলেছিলেন, “পড়তে তো ভাল লাগছে। কিন্তু এখানে মানুষের কথা কই?” আমার জানতে ইচ্ছে করেছিল, আমি নিজেই কি যথেষ্ট মানুষ নই যে, আমার কথাগুলোতে মানুষের মালিকানা থাকছে না! এমনই কিছু বদ্ধমূল ধারণার সামনে একেকজন শিল্পীর মধ্যে বিষাদ-যোগ দেখা দেয়। অনেকসময় হতাশ হয়ে তিনি একগাছা দড়ির কথা ভাবেন, এবং অশত্থ গাছের সন্ধান করেন।
এমন কোনোকিছুই নেই, যা সব মানুষ গ্রহণ করতে পারে। ভালবাসা গ্রহণ করতেও সব মানুষ সক্ষম হয় না। এমন কোনোকিছুও কি আছে, যা কোনো মানুষই গ্রহণ করতে পারে না? আত্মহত্যায় ইচ্ছুক মানুষ তো নাইট্রিক অ্যাসিডকেও পাকস্থলীতে গ্রহণ করে! মানুষ আগ্নেয়গিরির গর্তে ঝাঁপ দিয়েও মৃত্যু খুঁজে নেয়। মেট্রোর সামনে লাফিয়ে পড়ে। পুরোটাই ব্যক্তিগত এবং ক্ষণিক ব্যাপার। শিল্প চিরকালই একজন মানুষের থেকে আরেকজন মানুষের দিকে যায়। সেই একজন মানুষ একটা ভিড়ের অংশ হতেই পারেন, কিন্তু সমষ্টি কী চায়, সেটা বুঝে নিয়ে সাহিত্য রচনা বা ছবি আঁকা বা সিনেমা বানানো একট অদ্ভুত কাজ। সমষ্টির নিজের তো কোনো মুখই নেই। তাকে ‘মানুষ’ বলে চেনা গেল কী করে? একটা সিনেমা যখন দর্শকের কাছে যায়, একটা উপন্যাস যখন পাঠকের জন্য প্রকাশিত হয়, সে তখন মানুষ বলতে কী বুঝবে? প্রত্যেক মানুষের প্রতিক্রিয়াই তো তখন আলাদা-আলাদা হবে। অজস্র মানুষ অবশ্যই আছেন যাঁদের ‘পথের পাঁচালি’ ভাল লাগেনি, উপন্যাস হোক, বা সিনেমা। কেন ভাল লাগেনি এই প্রশ্ন করে যদি এমন উত্তরের দিকে যাওয়া হয় যে তাঁরা ‘পথের পাঁচালি’ পছন্দ করেননি বলেই তাঁরা অধম শ্রেণীর মানুষ, তাহলে ‘মানুষ’ শব্দটার উপরে বড্ড বেশিরকম একমাত্রিকতা আরোপ করা হয়ে যায়। এমন মানুষও দার্জিলিং শহরে নিশ্চয়ই আছে যার কাঞ্চনজঙ্ঘার উপরে প্রভাতী সূর্যের আলো দেখার ইচ্ছা কোনোকালেই হয়নি।
মানুষ যা নিতে পারবে, সেটাই যদি লিখতে হয়, তাই যদি গড়তে হয়, যদি ধরেই নিই সেটা লেখা বা গড়ে ফেলা সম্ভব, তাহলে সেই টার্গেট মানুষ কারা সেটা আগে জানতে হবে। সেটা কে জানতে পারে? সবরকম বিনোদনের মশলা থাকা সত্ত্বেও একটা সিনেমা ফ্লপ হতে পারে। একটা উপন্যাস বিক্রি নাও হতে পারে। পরিচালক বা লেখক কি তাহলে আগে ঘরে ঘরে ঘুরে লোকজনের গ্রহণক্ষমতার সার্ভে করবেন? সেই অনুযায়ী সিনেমা বা উপন্যাস নামক একটি প্রোডাক্ট বাজারে ছাড়বেন? সেক্ষেত্রে নির্মাণ করে বা লিখে কী লাভ? আপনি যদি আপনার টার্গেট দর্শকের বা পাঠকের পছন্দ-অপছন্দ জেনেই গেলেন, তাহলে আর আপনি নিজের হয়ে সৃষ্টি কী করলেন! মার্কেট সার্ভে করে অনেক মানুষ যা নিতে পারে, এমন লেখা বা এমন ছবি হয়ত অনেকেই বানাতে পারবেন। কাজটা সোজা এমন বলছি না। সামাজিক মনঃস্তত্বকে বোঝা খুবই দুরূহ ব্যাপার। কেউ কেউ পেরে যান। সেটার ফলে সমাজের যে বিস্তর উপকার হয়, এমনও তো নয়! সেটা শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পেরেছিলেন, জগদীশ গুপ্ত পারেননি। পরিচালক অজয় কর পেরেছিলেন, আরেক পরিচালক রাজেন তরফদার পারেননি। সোজা নয় বলেই বাঙালি সমাজে যাঁরা জনপ্রিয় হয়েছেন, তাঁরা তাঁদের কর্মকুশলতার জন্যই সফলতা ও পুরস্কার এমন কি অবিনশ্বরতাও লাভ করেছেন।
শিল্প বা কাব্যকে যে খুব দুরূহতম কাজ হতেই হবে, এমন কোনো কথাও নেই। এক মিনিটের মধ্যেই একটা অসামান্য ছবি আঁকা বা একটা কালজয়ী কবিতা লেখা হয়ে যেতে পারে। অনেক হয়েছে তেমন। এক বছর বা দশ বছর চেষ্টার পরেও একটা ব্যর্থ কিছু তৈরি হতে পারে। আবার উল্টোটাও সত্যি। ধর তক্তা মার পেরেক করতে গিয়ে অনেক শিল্প বা লেখা নষ্ট হয়ে যায়।
সময় কোনো ধ্রুবক নয় সৃষ্টির ক্ষেত্রে।
অনুপম মুখোপাধ্যায়
পরিচালক- ‘বাক্ অনলাইন’